একাত্তরে যে কজন সাঁওতাল যুবক দেশমাতৃকার টানে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম রুদ্রকুণ্ডর আমিন হেমরম অন্যতম।
বাড়িতে বসেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে যুদ্ধের দিনগুলির কথা শুনিয়েছেন সহজ-সরল এই মানুষটি। ৭৭ বছর বয়সেও স্মৃতিশক্তিতে কোনো চিড় ধরেনি। এখনও দিনভর প্রচুর পরিশ্রম করেন।
আমিন হেমরম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ২৬ বছরের যুবক। গ্রামের বাড়িতেই বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন। পরিবার বেশ বড় ছিল। বাবা-মা ছাড়াও পাঁচ ভাই, তিন বোন আর দাদীমা ছিলেন। গ্রামে বাঙালি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাসিন্দারা দীর্ঘকাল ধরেই একসঙ্গে বসবাস করে আসছে।
২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা আমনুরাসহ আশপাশের এলাকায় বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট আর গণহত্যা শুরু করে। তখন নিজেদের সম্প্রদায়ের অন্য অনেক পরিবারের সঙ্গে আমিন হেমরমের পরিবারও শরণার্থী হিসেবে ভারতে পাড়ি জমায়।
সাঁওতাল এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “প্রথমে আমরা গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলওয়ে স্টেশনের বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার সিংগাবাদ এলাকায় যাই। সেখানে পরিবারের সবাই ক্যাম্প পুকুর এলাকায় আশ্রয় নেই।
“পরদিন সেখান থেকে বাঙ্গীটোলা স্কুলে আমাদের পাঠানো হয়। প্রায় এক মাস আমরা সেখানে ছিলাম। তারপর আমাদের কুতুব শহর শরণার্থী ক্যাম্পে স্থানান্তরিত করা হয়।”
সেখানেই আমিন হেমরমের পরিচয় হয় রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতা সংগ্রাম মাঝির সঙ্গে। সংগ্রাম মাঝি তাদের বলেন, ‘দেশকে স্বাধীন করতে হবে। অন্যের দেশে কতদিন শরণার্থী হিসেবে থাকব। যুদ্ধ করে নিজের দেশকে স্বাধীন করতে হবে।’
আমিন হেমরম বলেন, সংগ্রাম মাঝির কথাগুলো তাদের খুব উদ্দীপ্ত করেছিল। মূলত তার আহ্বানে সাড়া দিয়েই তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে তিনি অন্য কয়েকজন যুবকের সঙ্গে চলে যান মালদহ জেলার গৌড়বাগান এলাকার ইয়ুথ ক্যাম্পে।
“একসময় প্রাণভয়ে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে পরিবারের সবার সঙ্গে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এখন প্রাণকে তুচ্ছ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য নাম লিখালাম। টানা দুই সপ্তাহ প্রশিক্ষণ চলল। এটা ছিল প্রাথমিক প্রশিক্ষণ।
অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আমিন হেমরমসহ অন্যদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলিগুড়ির আরেকটি ক্যাম্পে। সেখানেও তাদের টানা দুই সপ্তাহ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের দিনাজপুর (উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর) জেলায়। সেখানেই তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়।
আমিন হেমরম বলেন, “অস্ত্র পাওয়ার পর আমরা ৭ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুক্ত হই। এই সেক্টরের যোদ্ধারা রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া ও দিনাজপুরের কিছু অংশ জুড়ে যুদ্ধ করেন। আমরা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশ নেই।
“আব্দুস সামাদ কমান্ডার ছিলেন আমাদের দলনেতা। কমান্ডারের নেতৃত্বে আমরা সোনামসজিদেরর কলাবাগান সীমান্ত অতিক্রম করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে প্রবেশ করি। আমাদের প্রথম যুদ্ধ ছিল আড়গাড়া হাটে। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্প ছিল। টানা যুদ্ধে হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আড়গাড়া হাট শত্রুমুক্ত হয়।
এরপর মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা আবার তাদের ভারতের ক্যাম্পে ফিরে যান। সেখানে দুই-একদিন অবস্থান করে আবার দেশের ভেতরে প্রবেশ করেন। বিভিন্ন সময়ে গোমস্তাপুর, ভোলাহাটের কৃষ্টপুর ও গোমস্তাপুরের রহনপুরে কয়েকটি বড় যুদ্ধে অংশ নেন। এর বাইরে আরও কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বলে জানান আমিন হেমরম।
সাঁওতাল এই যোদ্ধা বলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পাই আমরা ভারতের ক্যাম্পে বসে। স্বাধীনতার খবর পাওয়ার পর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সবাই মিলে সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে আসি। যখন দেশ ছেড়ে যাই তখন পরাধীন ছিলাম। স্বাধীন হওয়ার পর যখন দেশে আসি তখন অনুভূতি একেবারে অন্যরকম ছিল। সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।“
স্ত্রী জমরি মুর্মু, এক ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে আমিন হেমরমের সংসার। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে সুবিতা হেমরম রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুণ্ডুমালা মহিলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্রী। নিজের ছয় বিঘা ফসলি জমি থাকলেও আমিনের পরিবার বাস করে খাস জমিতে। মাটির ঘরের উপরে টিন। এ গ্রামে আরও ২৮টি সাঁওতাল পরিবার বসবাস করে।
আমিন হেমরম জানালেন, তিনি শুরু থেকেই নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়ে আসছেন। তিনি আশা করেন, দেশ ভালভাবে চলবে। সব মানুষ এই স্বাধীন দেশে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করেন তার ছোট মেয়ে সুবিতা হেমরম।
তিনি বলেন, “দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমারও মনে আনন্দ হয় এই জন্য যে, এর পেছনে আমার বাবার ভূমিকা ছিল। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সবাই সম্মান করে। আমি আমার বাবাকে নিয়ে আনন্দিত, গর্বিত। বাবাকে নিয়ে আমাদের খুব গর্ব হয়।”
উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি হিংগু মুর্মু বলেন, “আমিন হেমরম সাঁওতাল সম্প্রদায়ের গর্ব। তাকে নিয়ে আমি আদিবাসী হিসেবে গর্ববোধ করি।”
নাচোল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, “আমিন হেমরম একজন প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল মানুষ।”