সেদিন সুসজ্জিত পাক বাহিনী সাধারণ মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে পরাজিত হয়।
চুয়াডাঙ্গার তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. আসহাব-উল হক এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও কুষ্টিয়ার সাবেক এমপি আব্দুর রউফ চৌধুরী দুজনই এখন প্রয়াত। মৃত্যুর আগে আগে তারা এই প্রতিনিধির সঙ্গে তাদের যুদ্ধের বিষয়ে কথা বলেছেন; স্মৃতিচারণ করেছেন। তাদের কথায় উঠে এসেছে যুদ্ধদিনের নানা কাহিনি।
২৫ মার্চ রাতে যশোর সেনানিবাস থেকে একটি সেনা কনভয় সুসজ্জিত হয়ে ঝিনাইদহের উপর দিয়ে কুষ্টিয়া যায়। তারা মোহিনী মিল, জিলা স্কুল ও পুলিশ লাইনে ঘাঁটি করে অবস্থান নেয়।
এদিকে তৎকালীন ইপিআর, পুলিশ, আনসার বাহিনী ও ছাত্র জনতা সংগঠিত হয়ে কুষ্টিয়ার পাক সেনা অবস্থানগুলো আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। চলে রণ প্রস্তুতি।
চুয়াডাঙ্গার তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য প্রয়াত ডা. আসহাব-উল হক মৃত্যুর আগে কয়েকবার এ প্রনিধির কাছে মুক্তিযুদ্ধের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন।
তার ভাষ্যে, ২৫ মার্চ রাতে মেজর আবু উসমান চৌধুরী অফিসের কাজে কুষ্টিয়া ছিলেন। পরের দিন তিনি ফিরে এসে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তিনি ও তার বাঙালি সৈনিকগণ বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। উইং হেড কোয়ার্টারে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। চুয়াডাঙ্গায় আঞ্চলিক কমান্ড হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। পরিকল্পনা চলতে থাকে কুষ্টিয়া আক্রমণের। ঝিনাইদহ, মাগুরা ও কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে শলাপরামর্শ চলতে থাকে।
আসহাব-উল হকের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের সঙ্গে বর্হিবিশ্বের যোগাযোগ বন্ধ ছিল। কুষ্টিয়া থেকে কলকাতা টেলিফোনের একটি ট্রাংক লাইন। ২৮ মার্চ ওই লাইনের কুষ্টিয়া অংশ কেটে কলকাতা অংশ চালু করে যোগায়োগ স্থাপনে চেষ্টা করা হয়। চুয়াডাঙ্গার টেলিফোন অপারেটরগণ সফল হন।
আসহাব-উল বলেন, ২৯ মার্চ কুষ্টিয়ার পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিগুলো আক্রমণের পরিকল্পনা হয়। পরে একদিন পিছিয়ে ৩০ মার্চ ভোরে একসঙ্গে তিন দিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়। মোহিনী মিলে আক্রমণ করে পাক ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়। পাক সেনারা পালিয়ে জিলা স্কুলে এসে জড়ো হয়। পুলিশ লাইনে দুপক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। বিকালে পুলিশ লাইন পাক ঘাঁটির পতন হয়। সেখান থেকে পাক সেনারা জিলা স্কুলে এসে অবস্থান নেয়।
কুষ্টিয়ার এমপি আব্দুর রউফ চৌধুরী নিজ বাসভবনে এ প্রতিনিধির সঙ্গে স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনিও এখন প্রয়াত।
তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানি সেনাদের মাঝে আতংক সৃষ্টির জন্য জিলা স্কুলের তিন দিকে আগুন ধরানোর পরিকল্পনা হয়। সেনাদের পালানোর জন্য যশোর রোড খোলা রাখা হয়।
এদিকে, শৈলকুপার গাড়াগঞ্জে কুমার নদের সেতুর দক্ষিণ পাশে গভীর খাদ কেটে তার উপর চাটাই বিছিয়ে তার উপর আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে নকল রাস্তা তৈরি করে ফাঁদ পাতা হয়। আর ব্রিজের চারদিকে বাংকার খুঁড়ে অবস্থান নেন আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ৩০ মার্চ রাত ৯টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে পালানোর সময় গাড়াগঞ্জে পাতা ফাঁদে পড়ে পাক সেনারা। সামনের গাড়ি খাদের মধ্যে পড়ে, অন্য গাড়িগুলো রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে যায়। পাক সেনারা দুটি কামানের গোলা ছোড়ে। তখন চারদিকের বাংকার থেকে আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা পাকসেনাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। একই সঙ্গে চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ জয়বাংলা শ্লোগান দিতে থাকে। পাক সেনারা নীরব হয়ে যায়। তারা আশপাশের জঙ্গলে ও খড়ের গাদার গিয়ে লুকিয়ে পড়ে।
সকালে জনতা রাম দা, তলোয়ার, কুড়াল লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণ করে। তাদের তাড়া করে কুপিয়ে, পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে জনতা।
ওই সময় পাকিস্তানি সেনা অফিসার লেফট্যানেন্ট আতাউল্লাহ খানকে আটক করে। তাকে আহত অবস্থায় শৈলকুপা উপজেলা হাসপাতালে এনে চিকিৎসা দেওয়া হয়; পরে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ যুদ্ধজয়ের খবর সংগ্রহ করতে ভারতসহ বিভিন্ন বিদেশি সাংবাদিকগণ আসেন। ভারতীয় ও অন্য দেশের গণমাধ্যমে এ যুদ্ধজয়ের খবর ব্যাপকভাবে প্রচার হয়।