শংকরদহ গ্রামের বকুলতলা গায়েবি মসজিদে এই হত্যাযজ্ঞের কয়েকজন সাক্ষী এখনও বেঁচে আছেন; তারা স্মৃতিচারণ করেছেন।
যুদ্ধের কারণে এমনিতেই তখন এলাকায় লোকজন কম ছিল; চৈত্র মাসের কোনো এক সোমবার জোহরের নামাজ পড়তে দাঁড়িয়েছিলেন ছোট-বড় মিলিয়ে ১৭ জন। ১৪-১৫ জন পাকিস্তানি সেনাসদস্য তাদের ওপর পিছন থেকে ব্রাশ ফায়ার করে।
নিহত ১৪ জনের মধ্যে শংকরদহ গ্রামের সরফ উদ্দিনও ছিলেন। তার ছেলে নুরুল ইসলাম (৭২) এখনও জীবিত। ঘটনার সময় তিনি ২১-২২ বছরের তরুণ।
গত ১ জানুয়ারি নুরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলেন, “যুদ্ধের সময় মসজিদটি যেখানে ছিল এখন সেখানে নেই। তিস্তা নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে সেটি দেবে গেছে। পরে স্থানীয়রা একই নামে পাশে একটু দূরে আরেকটি মসজিদ বানায়।
নুরুল বলেন, “আমি বাড়িতেই ছিলাম। নামাজ শুরুর পর হঠাৎ করেই অনবরত গুলির শব্দ শুনতে পাই। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘরের এক কোণায় গিয়ে লুকিয়ে পড়ি। সেখান থেকে শুধু গুলির শব্দ শুনতে পাই।”
এর তিনদিন আগে শংকরদহ গ্রামেই চাচা মহির উদ্দিনসহ আরও দুজনকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে বলে জানান নুরুল ইসলাম।
“আব্বার লাশ মসজিদে রক্তের মধ্যে পড়ে ছিল। আমরা গিয়ে বাড়ি নিয়ে আসি। পরে সব লাশ মসজিদের সামনেই কবর দেই। এরপর আমরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাই,” যোগ করেন শহীদ সরফ উদ্দিন ছেলে।
একই গ্রামের আফছার আলী (৬৫) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বকুলতলা মসজিদ আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে। সেদিন তো মসজিদ রক্তে ভেসে গেছে।
“এই ঘটনার পর নদীর ওইপাড় থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র নিয়ে এসে গুলি চালানো শুরু করেন। তখন একজন পাকিস্তানি সেনা মারাও যায়। পরে তারা পালিয়ে যায়।”
হাসেন বানু তখন কিশোরী, সবে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু তিনি শংকরদহে বাবার বাড়িতেই থাকতেন।
“আমাদের এই সমজিদটা ছিল গায়েবি মসজিদ। আর সেই মসজিদে ঢুকে তারা মানুষ মরল। আল্লাহতালা যেন তাদের বিচার করে,” বলেন হাসেন বানু।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেদিন জোহরের নামাজে ইমামতি করছিলেন তৈয়ব আলী। সেখানে অন্যদের মধ্যে আরও ছিলেন মহির উদ্দিন, নবির উদ্দিন, ১০ বছরের শিশু মনতাজ।
সরজমিনে দেখা যায়, বকুলতলা মসজিদ বা কবরের কোনো চিহ্ন সেখানে নেই। তিস্তার ভাঙনে সব বিলীন হয়ে গেছে। কিছুটা জায়গায় মাটি ভরাট করা হয়েছে। সেখানে তামাকপাতা শুকানো হয়।
শহীদ সহির উদ্দিনের ছেলে নুরুল ইসলাম বলেন, “এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য আমরা নিজেরাই চাঁদা তুলে ৭২ হাজার টাকা দিয়ে মাটি ভরাট করি। সরকারের লোকজন আসে আর যায়। কিন্তু কোনো কাজ আর হয় না। আমাদের আবেদন থাকবে, এই বধ্যভূমিটি যেন রক্ষা করা হয়।”
“এগুলো সংরক্ষণ করা দরকার। আমরা যখন থাকব না, আমরা পৃথিবী থেকে চলে যাব তখন এই স্মৃতিগুলোর কথা কেউ বলতে পারবে না।”
রংপুরের বধ্যভূমি সংরক্ষণ সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অনেক জায়গায় কিন্তু নানা রকম স্থাপনা গড়ে ওঠে। কিন্তু এক সময় দখলদারিত্বে হরিয়ে যায়।
বধ্যভূমি এবং গণকবর সংস্কারের জন্য সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ করছে উল্লেখ করে রংপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) আসিব আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রংপুরে যেসব বধ্যভূমি এখনও অরক্ষিত রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দমদমা বধ্যভূমি, টাউন হলের পেছনের বধ্যভূমি, সাহেবগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজ শেষ করা হয়েছে। সেসব বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ ও নামফলক বসানো হয়েছে। বাকিগুলোতেও পর্যায়ক্রেমে দৃশ্যমান হবে। এই প্রক্রিয়া এখনও চলমান রয়েছে।