বিয়ের পিঁড়িতে না বসে তারা যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে

মুক্তিযুদ্ধের আগে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জনমত গঠনের নানা কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন ঝালকাঠির রমা দাস; ঠিক তখনই বাড়িতে তার ডাক পড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসার। বিয়ের দিন-ক্ষণও ঠিক হয়; কিন্তু শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ।

পলাশ রায় ঝালকাঠি প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2022, 03:44 AM
Updated : 8 March 2022, 06:21 AM

রমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শুনিয়েছেন ৫০ বছর আগে তাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ সেই দেওয়ার গল্প।

“আমার বয়স তখন ২৬ বছর। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বাংলায় মাস্টার্সের লিখিত পরীক্ষা শেষ। ফেব্রুয়ারি মাসে কলাভবন, কার্জন হল, শহীদ মিনার চত্বরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকায় মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিচ্ছিলাম। মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে দলবেঁধে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে পোস্টার-ব্যানার ও দেয়ালে লিখতাম। এমন সময় বাবা নিয়ে গেলেন ঝালকাঠির বাড়িতে,” রমা বলেন।

ডাক বিভাগে চাকরি করতেন রমার বাবা।

ছেলের সঙ্গে রমা দাস।

রমার বিয়ে ঠিক হয় ঝালকাঠি শহরের পশ্চিম চাঁদকাঠির দাসবাড়ির ছেলে পার্থ সারথি দাসের সঙ্গে। পার্থর বয়স তখনও রমার চেয়ে চার বছর বেশি।

পারিবারিকভাবে চূড়ান্ত হয় দিন-ক্ষণ। রমার শাশুড়ি আংটি পরিয়ে আশীর্বাদ করেন।

রমা বলেন, “বিয়ের কিছুদিন বাকি। ঠিক এই সময় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। হানাদাররা ২৩ এপ্রিল ঝালকাঠি শহরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এর কয়েক দিন আগেই সপরিবার স্বরূপকাঠির আঁতা গ্রামে মামাবড়ি যাই আমরা। কিন্তু সেখানে রাজাকারদের তল্লাশি শুরু হয়। আমরা চলে যাই কলকাতা। পার্থ সারথির পরিবারও আলাদাভাবে কলকাতায় যায়। আমরা উঠি কলকাতার টালিগঞ্জে মামার বাড়িতে। আর পার্থরা এক গুরুদেবের বাড়িতে।”

কিন্তু রমা সেখানে চুপচাপ থাকতে পারছিলেন না। রাজনীতিতে যিনি সক্রিয় ছিলেন, যুদ্ধের সময় তার পক্ষে ঘরে বসে থাকা কঠিন।

জয়িতা সংগঠনের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা রমা দাসকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

রমা বলেন, “মন সারাক্ষণ ছটছট করতে থাকে। তারপর যোগাযোগ করি মুক্তিযুদ্ধের বরিশাল অঞ্চলের নৌ-কমান্ডার ক্যাপ্টেন বেগের সঙ্গে।”

বেগের সঙ্গে পেয়ারা-বাগানের মাদ্রা ক্যাম্পে পার্থ আর রমা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। ঝালকাঠির কীর্তিপাশা ক্যাম্পেও  প্রশিক্ষণ নেন পার্থ সারথি। সেখানে মেজর জলিলের সঙ্গে সুসম্পর্ক হয় পার্থ সারথির।

রমা বলেন, “ক্যাপটেন বেগ ভারতে মেজর জলিলের কাছে টাকির ক্যাম্পে নিয়ে যান আমাকে। মেজর জলিলের নির্দেশে অস্ত্র চালনা ও বিস্ফোরণ ঘটানোর বিশেষ প্রশিক্ষণ শুরু হয় আমার। আমি ছাড়া আরও ৪০-৪৫ জন মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় মেয়েদের ক্যাম্প।

“ওই কাম্প থেকে একই সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কথিকাও পড়তাম আমি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন বশিরহাটের হাসনাবাদের অন্তর্গত এ শিবির থেকে দুই-তিনজনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে খুলনা, সাতক্ষীরার আশাশুনি, কালিগঞ্জ, ভোমরা, দেবহাটাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে গোয়েন্দাগিরি করতেও যেতে হতো আমাদের।”

পার্থ সারথিও একই ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখানে গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করতেন তিনি।

দুই মেয়ে ও এক ছেলের সঙ্গে পার্থসারথী দাস ও রমা দাস।

দুই মেয়ে ও এক ছেলের সঙ্গে পার্থসারথী দাস ও রমা দাস।

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কলকাতার কালিঘাটে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে রমা আর পার্থর বিয়ে হয়।

পার্থ বলেন, “এক কাপড়ে বিয়ে হয়। ভালো কাপড়চোপড় কেনার সামর্থ্য ছিল না আমাদের দুই পরিবারের কারোরই। তবে রাষ্ট্র আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। বিশেষ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার সরকার। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজও দেশে শ্রেণিবৈষম্য আর রাজাকারদের প্রভাব রয়েই গেছে। এমন বাংলাদেশ আমারা দেখতে চাইনি।”

স্বাধীনতার পর ঝালকাঠি ফিরে শিক্ষকতা শুরু করেন তারা। পার্থ যোগ দেন ঝালকাঠি মহিলা কলেজে।

আর ঝালকাঠি সরকারি হরচন্দ্র বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে যোগ দেন রমা।

রমা বলেন, তিনি ২০০৩ সালে অবসর নিয়েছেন। পার্থও অবসর নিয়েছেন। দুইজনই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পাশাপাশি পেয়েছেন ঝালকাঠি জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন সম্মাননা।