বিলোনিয়া যুদ্ধ: যে সমর কৌশল পাঠ্য বহু দেশে

মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টরের অধীন ফেনীর সীমান্তবর্তী বিলোনিয়া অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখা মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে ভৌগোলিক-সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই এখানে দফায় দফায় যুদ্ধ হয়েছে; সেই যুদ্ধের ইতিহাস দেশের সীমানার গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে।

নাজমুল হক শামীম ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2022, 03:53 AM
Updated : 7 March 2022, 03:53 AM

বিলোনিয়া সীমান্তের একপাশে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। ওই সীমান্ত দিয়ে মুক্তিকামী মানুষ ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যেত, ভারত থেকে অস্ত্র ও নানা সহযোগিতাও আসত এ পথ ধরে। মুক্তিবাহিনীর এই তৎপরতা ঠেকানো এবং রেলপথে চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ ধরে রাখার জন্যও জায়গাটি নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই এখানে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছে, যেটা ২১ জুন পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে গেছে মুক্তিকামী বাহিনী। পরে দ্বিতীয় দফায় নভেম্বরের যুদ্ধে এই অঞ্চল মুক্ত করা হয়। এটি বিভিন্ন দেশের সামরিক কলেজে ‘ব্যাটল অব বিলোনিয়া’ নামে পাঠ্য।

২ নম্বর সেক্টরের অধীন এই যুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম বীর বিক্রম। তিনি পরে এ নিয়ে ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ নামে বই লিখেছেন। এ ছাড়া পাইওনিয়ার প্লাটুনের বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মুস্তাফা সম্পাদিত ‘ফেনী-বিলোনিয়া: রণাঙ্গণের এক প্রান্তর’ বইয়েও এই যুদ্ধের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করা হয়েছে।

বিলোনিয়ার এই যুদ্ধটি এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অসম্ভব সাহসী একটি যুদ্ধ বলে মন্তব্য করেন মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন। 

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিল-মে মাসে আমরা এখানে প্রতিরোধ যুদ্ধ করি। কিন্তু জুনের শেষদিকে অঞ্চলটি ধরে রাখা যায়নি।

“পরে অবশ্য আমি প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে দাগনভুঁইয়া-রাজাপুর-সিন্দুরপুরে যুদ্ধ করেছি,” যোগ করেন ফেনী মহকুমার এই কমান্ডার।

অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাফর ইমাম বীর বিক্রম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আগে আমি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পদাতিক বাহিনীতে ক্যাপ্টেন হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ২৬ মার্চ রাতে ক্যান্টনমেন্টে আমার সঙ্গের আরেকজন বাঙালি অফিসারকে নিরস্ত্র করে বন্দি করে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকেও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বদলির উদ্দেশ্যে আরও কয়েকজন অফিসারসহ হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা পুরাতন বিমানবন্দরে হেলিকপ্টারটি অবতরণের পর বুদ্ধি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এয়ারপোর্ট টয়লেটে ঢুকে পড়ি। ইউনিফর্ম খুলে সিভিল পোশাক পরে এয়ারপোর্টের বাইরে চলে আসি।”

“১৯৭১-এর এপ্রিলের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকে আমি কুমিল্লার কসবা সীমান্ত অতিক্রম করি। পরে ভারতের মেঘালয়ে ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সেখানে কর্নেল এম এ জি ওসমানীও ছিলেন। তিনিই আমাকে পাঠালেন বিলোনিয়া সেক্টরে।“

জাফর ইমাম বলেন, “এক পর্যায়ে ৩ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হেলাল মোর্শেদকে পরে ডেকে আনা হয় এই যুদ্ধে। পাক বাহিনীর অবস্থান ছিল এখানে দুটি স্থানে (পরশুরাম ও চিথলীয়া)। দল দুটির ৮০ ভাগ সৈন্যই পুরনো বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য। আধুনিক সমরবিদ্যায় প্রশিক্ষিত তারা। অস্ত্রেও দল দুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। আরও অনেকে ছিলেন।”

ফেনী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল মোতালেব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস। পাকিস্তানিরা যুদ্ধরসদ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। তখন চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের প্রবেশদ্বার ফেনী। ভৌগলিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান। একদিকে ভারত, অন্যদিকে সাগর। পাকিস্তানিরা বিলোনিয়ার প্রথম যুদ্ধের পর চারটি হেলিকপ্টার নিয়ে দখল করে রেখেছে এলাকা। মুক্তিযোদ্ধারাও সংকল্পবদ্ধ যেভাবেই হোক মুক্ত করতে হবে বিলোনিয়া। পাকিস্তানিরা তাদের হেলিকপ্টারের রং অনেকটা ভারতের হেলিকপ্টারের রংয়ের মতো করে অবতরণ করে এবং গোলাগুলি আরম্ভ করে।
মোতালেব জানান, বিলোনিয়ায় সামরিক বাহিনীর যোদ্ধা বেশি ছিল। বেসামরিক যোদ্ধাও ছিলেন অনেকে। অনেকেই তো আজ আর জীবিত নেই। সেই যোদ্ধাদের মধ্যে হুমায়ুন শাহরিয়ার, নজরুল ইসলাম ভুট্টো, আবুল বাশার, কাজী আব্দুর রহিম, হাবিবুর মোস্তাফা, বাহার ছিলেন।
‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’য় জাফর ইমাম যুদ্ধের বিষয়ে বলেছেন, ১৯৭১ এর ৫ নভেম্বর, মধ্যরাত। অন্ধকারে একদিক থেকে দশম রেজিমেন্ট আরেক দিক থেকে দ্বিতীয় রেজিমেন্ট গোপনে ভারতের অংশ থেকে বাংলাদেশের মাটিতে প্রবেশ শুরু করে। প্রথমে ‘ব্রাভো কোম্পানি’, পরে ‘সেকেন্ড চার্লি কোম্পানি’ এবং একেবারে পেছনে হেলাল মোর্শেদের ‘ডেল্টা কোম্পানি’। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ফাঁকা জায়গাগুলো দিয়ে মুহুরী নদী পেরিয়ে মুক্তিবাহিনীর দলগুলো নীরবে এগিয়ে যায় সলিয়ার দিকে। এরপর ১ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন মাহফুজ তার কোম্পানি নিয়ে গুথুমা দিয়ে ঢুকে ব্রাভো কোম্পানির সামনের অংশের সঙ্গে যোগ দেন। মুহুরী নদীর পূর্বপাড়ের ধনিকুন্ডায় এসে পড়ে আলফা কোম্পানি।

শীতের রাতে কোথাও বুক পানি, কোথাও কোমর পানি, কোথাও আবার পিচ্ছিল কর্দমাক্ত পথ ধরে এগিয়ে চলতে থাকে সবাই। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনারা যার যার নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নিয়ে বাংকার খুঁড়তে থাকে। হাড়কাঁপানো শীতের আশীর্বাদ হয়েই দাঁড়ায় বৃষ্টি। এত বড় বাহিনীর পায়ের শব্দ আর বাংকার খোঁড়ার শব্দ মুহূর্তে হারিয়ে যায় বৃষ্টির ঝুম ঝুম শব্দে।

রেললাইনের ধারের বাংকারে ছিলেন সুবেদার এয়ার আহমেদ (পরে বীর বিক্রম)। হঠাৎই একটি শব্দে ভোরের নীরবতা ভেঙে যায়। ৬ নভেম্বর ভোরে ফেনী-বিলোনিয়া রেলসড়ক ধরে ফুলগাজীর দিক থেকে একটি ট্রলি এগিয়ে আসছে। ওই ট্রলিতে চার জওয়ানকে নিয়ে চিথলিয়ার দিকে আসছিল এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন। পরিখায় থাকা মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার এয়ার আহমেদ ও সঙ্গীদের নাগালের মধ্যে ট্রলিটি আসতেই বাংকার থেকে গর্জে ওঠে হালকা মেশিন গান। ভোরের আলো ফুটতেই মুক্তিযোদ্ধরা ধ্বংস করে দেয় রেললাইনে থাকা পাকবাহিনীর ট্রলি। সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয় ওই পাঁচ পাকিস্তানি শত্রু। বিলোনিয়াকে মুক্ত করার যুদ্ধে প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয় মুক্তিবাহিনীর।
এয়ার আহমেদ বাংকার থেকে বের হয়ে মৃত পাক অফিসারের পিস্তলটি নিয়ে ফেরত আসছিলেন। এমন সময় কোথা থেকে একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় তার মাথায়। গুলির শব্দে পরশুরাম এবং চিতলীয়া দুই ঘাঁটিই সতর্ক হয়ে ওঠেছিল। দুই অবস্থান থেকেই এলোপাথাড়ি পাল্টা গুলি শুরু করেছিল পাকবাহিনী। সহযোদ্ধা সুবেদার এয়ার আহমেদকে হারিয়ে প্রতিশোধের আগুনে আরও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী।

৯ নভেম্বর থেমে থেমে যুদ্ধ চলে সারাদিন। পাক বাহিনীর বিরামহীন আর্টিলারি শেলিংয়ে পুরো এলাকা কেঁপে উঠলেও মুক্তিবাহিনীর তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি তারা। এবার পাকিস্তানীরা শুরু করে সর্বাত্বক বিমান হামলা। ঘণ্টায় ১,০৪৬ কিলোমিটার গতিতে উড়তে থাকা স্যাবর যুদ্ধ বিমান দিয়ে সাধারণ গ্রামবাসীর উপর চলতে থাকে বিমান হামলা। শত্রুপক্ষের চারটি এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান (স্যাবর জেট) সব এলাকা ঘুরে ঘুরে নিচু হয়ে মেশিনগান ও রকেট হামলা চালাচ্ছিল। শব্দের চেয়েও দ্রুত গতিতে চলতে থাকা বিমান মেশিনগান দিয়ে ধ্বংস করা একরকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়! মুক্তিবাহিনীর কাছে কোনো বিমান-বিধ্বংসী অস্ত্র না থাকায় হাতে থাকা মিডিয়াম মেশিনগান দিয়েই স্যাবরকে গুলি করার সিদ্ধান্ত হয়। তখনই হাবিলদার হাশমতের মেশিনগান থেকে গুলি নির্ভুল আঘাত হানে শত্রুবিমানে। বিমানটি পরে কুমিল্লার লাকসাম এলাকায় বিদ্ধস্ত হয়। মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের আর্টিলারি সাপোর্টে শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হতাহত হয় পাক বাহিনীর প্রায় ২০০ সৈনিক। এ যুদ্ধে দুই ঘাঁটির পাকিস্তানি সেনারা এককভাবে আত্মসমর্পণ করে। সেসময় ৭০ জন সৈনিক এবং দুই জন অফিসার মুক্তিযুদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয়ে ১০ নভেম্বর মুক্ত হয় বিলোনিয়া। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান কণ্ঠে উল্লসিত হয়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। এরই ধারাবাহিকতায় ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয়েছিল ফেনী।

দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল্লাহ বাহার ভূঁইয়া ও ফেনীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের কারণেই ফুলগাজীর সুবেদার হাজী মধু মিয়া বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন। তিনি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি মারা যান।