বিলোনিয়া সীমান্তের একপাশে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। ওই সীমান্ত দিয়ে মুক্তিকামী মানুষ ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যেত, ভারত থেকে অস্ত্র ও নানা সহযোগিতাও আসত এ পথ ধরে। মুক্তিবাহিনীর এই তৎপরতা ঠেকানো এবং রেলপথে চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ ধরে রাখার জন্যও জায়গাটি নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই এখানে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছে, যেটা ২১ জুন পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে গেছে মুক্তিকামী বাহিনী। পরে দ্বিতীয় দফায় নভেম্বরের যুদ্ধে এই অঞ্চল মুক্ত করা হয়। এটি বিভিন্ন দেশের সামরিক কলেজে ‘ব্যাটল অব বিলোনিয়া’ নামে পাঠ্য।
বিলোনিয়ার এই যুদ্ধটি এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অসম্ভব সাহসী একটি যুদ্ধ বলে মন্তব্য করেন মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিল-মে মাসে আমরা এখানে প্রতিরোধ যুদ্ধ করি। কিন্তু জুনের শেষদিকে অঞ্চলটি ধরে রাখা যায়নি।
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাফর ইমাম বীর বিক্রম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আগে আমি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পদাতিক বাহিনীতে ক্যাপ্টেন হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ২৬ মার্চ রাতে ক্যান্টনমেন্টে আমার সঙ্গের আরেকজন বাঙালি অফিসারকে নিরস্ত্র করে বন্দি করে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকেও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বদলির উদ্দেশ্যে আরও কয়েকজন অফিসারসহ হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা পুরাতন বিমানবন্দরে হেলিকপ্টারটি অবতরণের পর বুদ্ধি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এয়ারপোর্ট টয়লেটে ঢুকে পড়ি। ইউনিফর্ম খুলে সিভিল পোশাক পরে এয়ারপোর্টের বাইরে চলে আসি।”
জাফর ইমাম বলেন, “এক পর্যায়ে ৩ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হেলাল মোর্শেদকে পরে ডেকে আনা হয় এই যুদ্ধে। পাক বাহিনীর অবস্থান ছিল এখানে দুটি স্থানে (পরশুরাম ও চিথলীয়া)। দল দুটির ৮০ ভাগ সৈন্যই পুরনো বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য। আধুনিক সমরবিদ্যায় প্রশিক্ষিত তারা। অস্ত্রেও দল দুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। আরও অনেকে ছিলেন।”
শীতের রাতে কোথাও বুক পানি, কোথাও কোমর পানি, কোথাও আবার পিচ্ছিল কর্দমাক্ত পথ ধরে এগিয়ে চলতে থাকে সবাই। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনারা যার যার নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নিয়ে বাংকার খুঁড়তে থাকে। হাড়কাঁপানো শীতের আশীর্বাদ হয়েই দাঁড়ায় বৃষ্টি। এত বড় বাহিনীর পায়ের শব্দ আর বাংকার খোঁড়ার শব্দ মুহূর্তে হারিয়ে যায় বৃষ্টির ঝুম ঝুম শব্দে।
৯ নভেম্বর থেমে থেমে যুদ্ধ চলে সারাদিন। পাক বাহিনীর বিরামহীন আর্টিলারি শেলিংয়ে পুরো এলাকা কেঁপে উঠলেও মুক্তিবাহিনীর তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি তারা। এবার পাকিস্তানীরা শুরু করে সর্বাত্বক বিমান হামলা। ঘণ্টায় ১,০৪৬ কিলোমিটার গতিতে উড়তে থাকা স্যাবর যুদ্ধ বিমান দিয়ে সাধারণ গ্রামবাসীর উপর চলতে থাকে বিমান হামলা। শত্রুপক্ষের চারটি এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান (স্যাবর জেট) সব এলাকা ঘুরে ঘুরে নিচু হয়ে মেশিনগান ও রকেট হামলা চালাচ্ছিল। শব্দের চেয়েও দ্রুত গতিতে চলতে থাকা বিমান মেশিনগান দিয়ে ধ্বংস করা একরকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়! মুক্তিবাহিনীর কাছে কোনো বিমান-বিধ্বংসী অস্ত্র না থাকায় হাতে থাকা মিডিয়াম মেশিনগান দিয়েই স্যাবরকে গুলি করার সিদ্ধান্ত হয়। তখনই হাবিলদার হাশমতের মেশিনগান থেকে গুলি নির্ভুল আঘাত হানে শত্রুবিমানে। বিমানটি পরে কুমিল্লার লাকসাম এলাকায় বিদ্ধস্ত হয়। মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের আর্টিলারি সাপোর্টে শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হতাহত হয় পাক বাহিনীর প্রায় ২০০ সৈনিক। এ যুদ্ধে দুই ঘাঁটির পাকিস্তানি সেনারা এককভাবে আত্মসমর্পণ করে। সেসময় ৭০ জন সৈনিক এবং দুই জন অফিসার মুক্তিযুদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল্লাহ বাহার ভূঁইয়া ও ফেনীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের কারণেই ফুলগাজীর সুবেদার হাজী মধু মিয়া বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন। তিনি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি মারা যান।