শিশুকে ছুড়ে ফেলে সুরবালাকে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা

১৯৭১ সালের এক শীতের দিন; দুপুর গড়িয়ে পড়ছে। সুরবালা মল্লিক ঘরের মেঝেতে বসে মেয়েকে বুকের দুধ দিচ্ছিলেন; ওই সময় হানা দেয় একদল পাকিস্তানি সেনা। কোলের সন্তানকে ছুড়ে ফেলে তুলে নিয়ে যায় সুরবালাকে। নিজেকে রক্ষার সব চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন যুদ্ধের ময়দানে আটকেপড়া এই নারী। 

আবুল হোসেন গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 March 2022, 03:36 AM
Updated : 6 March 2022, 03:36 AM

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নিভৃত পল্লি মাধবপুর। সেই গ্রামেরই বাসিন্দা যতীন্দ্র চন্দ্র মল্লিক। যুদ্ধের শুরুতেই গ্রামের অনেকেই শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যায়। কিন্তু সুরবালার স্বামী যেতে পারেননি। একে তো সুরবালার কোলে তিন-চার মাসের সন্তান। তাছাড়া দেশ ছাড়লে খাবেন কী – এই চিন্তায় আর বাড়ি ছাড়লেন না।

“সেই তো বিপদ হইল। আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেছিলাম। কিন্তু পরে আবার ফিইর‌্যা আসছি। তার কয়েকদিন পরেই তো...,” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন সুরবালা।

মাধবপুর গ্রামটি ভৌগোলিক দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। খানিক দূরেই ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ, সেটি গিয়েছে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসের ভেতর দিয়ে। যোগাযোগের জন্য পথটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য খুব সহজ ছিল। কাছেই ইজ্জতপুর বড় রেলসেতু; পাহারা বসেছে জায়গায়-জায়গায়। বলতে গেলে, সেনা গ্যারিসনের পেটের মধ্যেই ছিল হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামটি।

যুদ্ধের সেই দিনের বর্ণনা করছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরবালা। শ্রীপুরের রাজাবাড়ী ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল হাসেম আকন্দও সেদিনগুলোর কথা বলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।  

সুরবালা বলেন, “নানা জায়গা থাইক্যা মানুষ মারার খবর আনত রিপনের বাপ (যতীন্দ্র চন্দ্র মল্লিক)। শুইন্যা ভয় লাগত। বড় মাইয়্যাটা মাত্র হইছে। সাতখামাইরে মানুষরে দাঁড় করাইয়া মারছে রেললাইনের পাশে। প্রতিদিনই তো গোলাগুলি হইত।”

সুরবালাদের নিম্নবিত্ত পরিবার। স্বামী যতীন্দ্র চন্দ্র মল্লিকের কিছু জমিজমা ছিল, তা দিয়েই তিনি কোনোরকমে পরিবার চালান। কৃষিকাজ বন্ধ থাকলে খাওয়াও বন্ধ। যুদ্ধের বাজারে তখন কৃষিকাজ করাও মুশকিল।

গ্রামের অনেক হিন্দু পরিবারই শরণার্থী হয়ে ভারত চলে গেছে। কিছু পরিবার এ গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে গেছে আত্মীয়ের বাড়ি। তবে মুসলিম পরিবারগুলো প্রায় সবই ছিল; তাদের সঙ্গে কয়েক ঘর দরিদ্র হিন্দুও থেকে যায়।

স্মৃতি কাতরতা নিয়েই গত সপ্তাহে নিজের বাড়িতে বসে সুরবালা রায় গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে এসব কথা বলছিলেন। এখন আর নিজে নিজে চলতে পারেন না। ছয় বছর আগে বৃষ্টির মধ্যে পিছলে উঠানে পড়ে যান, তখন থেকেই চলতে-ফিরতে কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। চোখেও কম দেখেন। ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপেও ভুগছেন তিনি। বাড়িতে ছোট ছোট তিনটি মাটির ঘর। তার একটিতে থাকেন এই নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা; কথা বলেন ধীরে ধীরে।

সুরবালা বলছিলেন, “আমার বড় মেয়ের বয়স তখন প্রায় এক বছর। সেনারা আইলে আমরা লুকাই, অন্যখানে চইল্যা যাই। এইভাবে আর কতদিন। সবখানে হামলা-নির্যাতনের খবর পাইতাছি। কাওরাইদ, সাতখামাইর, গোলাঘাট রেল ব্রিজ, ইজ্জতপুর ব্রিজ ও বলদি ঘাটে ক্যাম্প আছিল। কলেজের (শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী কলেজে) মধ্যে অনেকরে হিন্দু-মুসলমান মিলায় কবর দিছে। কেওয়া, উজিলাব, ইজ্জতপুর, গোসিঙ্গায় মারছে। পরে একদিন মেয়েরে নিয়া ঘরে তালা দিয়া কালীগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে যাই।

“একদিনে রিপনের বাপে কয়, এলাকায় পাক-সেনাদের আক্রমণ কমে আসছে। মুক্তিবাহিনী ঢুকছে। সেনারা ক্যাম্প থেকে বাইর হয় না। পরে আবার কালীগঞ্জ থেইক্যা মেয়ে নিয়া আমরা শ্রীপুরের বাড়ি ফিইর‌্যা আসি।”

একাত্তরের নির্যাতিতা এই নারী বলেন, “তখন তো মাটির ঘরের দরজা বলতে একটা বাঁশের বেড়া ছিল। ৬ ডিসেম্বর দুপুরে খাই আমরা। রিপনের বাপ একটু বাইরে যায়। ঘরের বাঁশের বেড়াটি চাপাইয়া মেঝেতে বসে মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। পাশেই বসেছিল ভাসুরের ১৩-১৪ বছরের কন্যা চপলা। বাড়িতে তো আর কেউ নাই। চারদিক সুনসান।

“হঠাৎ করেই ঘরের পাশের রাস্তায় কয়েকজনের বুটের আওয়াজ পাই। রাজাকাররাও আসে। আমি মেয়েকে কোলে নিয়েই দাঁড়াই। তার মধ্যেই তিনজন পাকিস্তানি সেনা বেড়ায় লাত্থি মেরে ঘরে ঢুকে পড়ে। আমাদের দিকে রাইফেল ধরে।”  

জোর করে চুলের মুঠ টেনে চপলা ও সুরবালাকে বাইরে নিয়ে যেতে চায়। শিশু মেয়েটারে কোল থেকে বিছানায় ছুড়ে ফেলে দেয় সেনারা। বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা জাম গাছ ছিল, সুরবালা সেটা জড়িয়ে ধরেন।

“তখন রাইফেলের বাঁট দিয়ে আমার কোমরে, পায়ে মারে। রক্ত বাইর হইতেছিল। হাতের মধ্যে রাইফেল দিয়া বাড়ি দিছে, আর আটকাইতে পারি নাই। চপলারেও মারছে।”

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তখন পাকিস্তানি সেনারা এ এলাকায় সাত-থেকে আটটির মতো ক্যাম্প করেছিল। তার একটি ছিল ইজ্জতপুর রেলসেতুর কাছে। সুরবালা ও তার ভাসুরের মেয়ে চপলাকে সেই ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যায় তিন পাকসেনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের ক্যাম্পে নেয়নি; নিয়ে যায় ইজ্জতপুর হাই স্কুলের একটি কক্ষে। সেখানেই তারা নির্যাতিত হন।

সন্ধ্যার দিকে গ্রামের লোকেরা বিষয়টি জানতে পেরে সবাই মিলে ক্যাম্পের দিকে যান। এটা দেখে তিন পাকিস্তানি সেনা তাদের ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।

এই ঘটনার পর যে কয়ঘর হিন্দু পরিবার গ্রামে ছিল তারা রাতারাতি এলাকা ছেড়ে দেয়। সুরবালাও নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে ফেলেন। সামাজিকভাবে তিনি খুব বেশি মানুষের সঙ্গে মিশতেন না। দেশ স্বাধীনের পর ঘটনা চাপিয়ে রেখেই ভাসুরকন্যার বিয়ে হয়। দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পর ভারতের কুচবিহারে চলে যায় এই দম্পতি। সেখানেই তারা এখনও বাসবাস করছেন। তাদের দুই সন্তান। 

সুরবালার ভাসুরের ছেলেরা এখনও এখানে আছেন। তাদের একজন জানান, বোনকে বিয়ে দেওয়ার ১২-১৩ বছর পরে বাবা মারা যান। আর চার বছর আগে মা মারা গেছেন।

সুরবালার ছেলে, পেশায় রিকশাচালক রিপন চন্দ্র মল্লিকের ভাষ্য, “বাবা এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নিছিলেন। তিনি মার দেখাশোনাও করছেন তখন। পরে তো বাবা নিজেই প্যারালাইজড হইয়া যায়।”

সুরবালার স্বামী মারা যান ১৯৮৬ সালে। অভাব-অনটনের মধ্যে দিন গেলেও সুরবালা কোনোদিন কারও কাছে গিয়ে এর জন্য সাহায্য চাননি। পড়াশোনা না জানায় সরকারি দপ্তরে যোগাযোগ বা কোনো আবেদনও করেননি। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, ছেলে রিপনকেও বিয়ে করিয়েছেন। রিপনের তিন মেয়ে; তাদের নিয়েই সুরবালার সংসার। 

সুরবালা গ্রামের দিকে হাত দেখিয়ে বলছিলেন, “এখন তো আমাদের সম্প্রদায়ের সবাই চলে গেছে; ২০-২২ ঘর আছে। বাকি সবাই মুসলমান। তারাও আসে, খোঁজ-খবর নেয়।”

সুরবালাকে নির্যাতনের বিষয়টি যুদ্ধ থেকে ফিরেই জানতে পরেছিলেন মো. আবুল হাসেম আকন্দ। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এখন রাজাবাড়ি ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্যাতনের পর থেকেই সুরবালা নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন, প্রকাশ্য হতেন না। বাড়ি থেকে তেমন বের হতেন না। তার কথা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রবীণ ব্যক্তিরাও জানতেন।”

“তখন লোকলজ্জার ভয়ে কেউ এ নিয়ে কোনো কথা বলত না; ফলে উনাকে সহযোগিতার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সবার চেষ্টায় তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন। এখনও উনার শরীর খারাপ। চিকিৎসা দরকার,” যোগ করেন কমান্ডার।

ছেলে রিপন চন্দ্র মল্লিক জানান, পারিবারিক অবস্থা খারাপ দেখে ২০১৯ সালে রাজাবাড়ি ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল হাসেম আকন্দ আবেদন করতে বলেন। তখন সুরবালা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য ইউএনও রেহানা বেগমের কাছে আবেদন করেন। পরে ইউএনও এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এসে সরেজমিন তদন্ত করেন, গ্রামের মানুষদের সাক্ষ্য নেন।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সুরবালা রায়কে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। এখন তিনি ভাতাও পাচ্ছেন। এ বছর বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে (মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে) সম্মাননাও পেয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত গ্যাজেটের ২৫৬১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ৩২৮ নম্বর ক্রমিকে সুরবালার নাম রয়েছে। গেজেটে তার মুক্তিযোদ্ধা নম্বর হলো ০১৩৩০০০৫৯০৭।

অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “জীবনের শেষ সময়ে আইসা স্বীকৃতি পাইছি, এতে আমি গর্বিত। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তারা আমার জন্য অনেক করছেন।”

ছেলে রিপন মল্লিক জানান, দুই মাস আগে সুরবালার ঘরের জন্য আবেদন করা হয়েছে। তবে এখনও তার বরাদ্দ পাননি।

শ্রীপুরের ইউএনও মো. তরিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুরবালার ঘরের আবেদন এরই মধ্যে সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর চিকিৎসার ব্যাপারেও তাকে সহযোগিতা করা হবে।”

গাজীপুরের শিশু ও মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা শাহনাজ আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুরবালা ছাড়াও জেলায় গেজেটভুক্ত আরও তিন নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এ দেশ স্বাধীনে তাদেরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।“