এখন পর্যন্ত জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে পাঁচটিতে এই কমিটি ১৩ হাজার শহীদের নাম পেয়েছে বলে দাবি করেছে; বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে ১৪টি।
দুই বছরে তারা সিরাজগঞ্জ প্রেসক্লাব ভবন এবং সদর উপজেলার শিয়ালকোলে পাঠাগার নির্মাণ করেছেন। শিয়ালকোলে বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজেও হাত দিয়েছেন।
“মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও বাংলাদেশ রক্ষা পাবে না। গ্রামে গ্রামে ঘুরে যে তালিকা সংগ্রহ করছি তা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হবে,” যোগ করেন মোফাজ্জল হোসেন।
এই কমিটির সদস্যরা জানান, সিরাজগঞ্জ শহরের পুরাতন জেলখানা ঘাট ছিল পাকসেনাদের গণহত্যা চালানোর প্রধান কেন্দ্র। বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাকবোঝাই করে বাঙালি নারী-পুরুষদের ধরে এনে এখানে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হতো। এখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষকে হত্যা করে লাশ যমুনা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
এই তালিকায় সদর, কামারখন্দ, উল্লাপাড়া, রায়গঞ্জ ও কাজীপুর উপজেলার গ্রামভিত্তিক গণহত্যার একটি চিত্র পাওয়া যায়।
এর মধ্যে রয়েছে সদরের বাহিরগোলা রেলওয়ে ব্রিজের উপরে ৩০ জন, পুরাতন পোস্ট অফিসের সামনে প্রায় ২৫০ জন, হরিণা বাগবাটি, আলোকদিয়া ও সূবর্ণগাতিতে ২৫০ জন, শিয়ালকোল মুছিবাড়িতে সাত জন, কালিয়া হরিপুর, চুনিয়াহাটি ও তেঁতুলিয়া গ্রামে ৪০ জন।
শহরের বাহিরগোলা রোডের বিদ্যুৎ অফিসের ভিতরে এবং এসএস রোডে বর্তমান রেজিস্ট্রি অফিসের ভিতরে কুয়ায় অন্তত ১০০ মানুষকে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়ার তথ্য পেয়েছে কমিটি।
উল্লাপাড়ার হাটিকুমরুল ইউনিয়নের চড়িয়া মধ্যপাড়া বাঁশের ঝাড় ও পাটধারী অন্ধপুকুরপাড় ও আশপাশের এলাকায় ৩৫০ জন, দ্বারিয়াপুরে ৮/৯ জন ও লাহিড়ী মোহনপুর হিন্দুপাড়ায় (লাহিড়ীপাড়া) ৩০ জন নিহতের নাম-পরিচয় তালিকাভুক্ত করেছে গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।
রায়গঞ্জের ভূইয়াগাতি সেতুর উপরে ৩০ জন এবং ধানগড়া এলাকাসহ হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে প্রায় এক হাজার নারী-পুরুষ গণহত্যার শিকার হয়েছেন।
কাজিপুরের বড়ইতলীতে ১১৭ জন, খামারপাড়ায় ৪/৫ জন, কাশিহাটায় চারজন ও গান্দাইল গ্রামে ১০/১২ জনকে হত্যা করেছে পাকসেনারা।
এরই ধারাবাহিকতায় এ বছর ১৭ এপ্রিল হবে ‘বাবার মুখ দেখিনি’ শিরোনামে অনুষ্ঠান। সেখানে সেইসব সন্তানদের আমন্ত্রণ জানানো হবে, যারা কোনোদিন তাদের বাবার মুখ দেখেনি। তাদেরকে মায়ের গর্ভে রেখে বাবা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, কিন্তু স্বাধীন দেশে তাদের বাবা আর ফিরে আসেননি।
এ বছর ২৬ মার্চ সিরাজগঞ্জ শহরের ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে তালিকা টাঙ্গানোর মধ্যে দিয়ে অনুসন্ধানে পাওয়া শহীদের নাম প্রকাশ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও জেলা বাসদের সমন্বয়ক নব কুমার কর্মকার।
শহীদ পরিবারের সদস্যরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে কমিটির এ ধরনের কাজের প্রশংসা করেন। তারা মনে করেন, এ ধরনের কাজে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মানুষের মধ্যে জাগরুক থাকবে। ভবিষ্যতেও তারা কমিটিকে সহয়তার আশ্বাস দেন।
কমিটির কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। এর মধ্যে শিয়ালকোলের আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী দিলরুবা খাতুন চিনি, মো. রাব্বী, মো. হৃদয়, তেলকুপি হিলফুল ফুজুল মডার্ন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির মোস্তফা রফিক নাহিদ, নবম শ্রেণির মারিয়া মাহজাবিন ও দশম শ্রেণির নুসরাত জাহান বিভিন্ন দিবসে এলাকার শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ফুল নিয়ে গিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
এ বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতি মনে পড়লে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এখনও কাঁদে। এই স্বাধীন দেশের জন্য অনেকের অবদান আছে, অথচ এমনও পরিবার আছে যাদের খোঁজও কেউ নেয় না।
“মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে এখনও তেমন কাজ হয়নি। সঠিক তালিকা প্রকাশেও রয়েছে গড়িমসি। যুদ্ধে অংশ নেওয়া সিরাজগঞ্জের এসডিও ইসমাইল হোসেন, বেলকুচি উপজেলা কমান্ডার কুয়াত-উল-ইসলামের নামই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে শহীদদের অসমাপ্ত তালিকা তৈরি করে প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে একটি করে চিঠি এবং সম্মানী বাবদ দুই হাজার করে টাকা পাঠিয়েছিলেন। অথচ এখন তাদের খোঁজও কেউ রাখে না।”
এ বিষয়ে যুদ্ধকালীন সিরাজগঞ্জে গড়ে ওঠা বেসরকারি সাব-সেক্টর পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের প্রধান কমান্ডার গাজী সোহরাব আলী সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শেষ করে আর কোনোদিকে তাকাইনি। কারো কোনো খোঁজ-খবরও রাখিনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে বের করতে সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার।”
আরো পড়ুন