বাড়ি ফেরার বড় তাড়া ছিল বাংলার সমৃদ্ধির প্রকৌশলী হাদিসুরের

দেশে ফিরলেই বাড়ির কাজে হাত দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল, স্বপ্ন ছিল পরিবারের জন্য আরও অনেক কিছু করার; সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরতে চাইছিলেন হাদিসুর রহমান।

বরগুনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2022, 07:58 AM
Updated : 14 March 2022, 09:09 AM

বুধবারও এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল মায়ের সঙ্গে, ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধির থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান এখন ফিরবেন কফিনবন্দি হয়ে। 

ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে ইউক্রেইনে গিয়ে যুদ্ধের মধ্যে আটকা পড়ে বাংলার সমৃদ্ধি। বুধবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যার দিকে অলিভিয়া বন্দরে নোঙ্গর করে থাকা জাহাজটি রকেট হামলার শিকার হয়। ক্রুদের চেষ্টায় আগুন নেভানো গেলেও ব্রিজে থাকা হাদিসুরের মৃত্যু হয়।

তার মৃত্যুর খবর ওলোটপালোট করে দিয়েছে পরিবারের সব পরিকল্পনা। বরগুনার বেতাগীর হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামে তার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে স্বজন আর প্রতিবেশীরা ভিড় করছেন ওই বাড়িতে।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে বাবা আবদুর রাজ্জাক মাস্টার বাকরুদ্ধ। মা রাশিদা বেগম মূর্ছা যাচ্ছেন বার বার।

হাদিসুর রহমানের পরিবারে চলছে শোকের মাতম

অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসা শিক্ষক রাজ্জাকের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে হাদিসুর ছিলেন মেজ। জাহাজের চাকরিতে বছরের একটি বড় সময় থাকতে হয় বাইরে। সবশেষ বাড়ি এসেছিলেন মাস ছয়েক আগে। তবে পরিবারের সঙ্গে কথা হত নিয়মিত।

ছোট ভাই তরিকুল ইসলাম তারেক জানান, বুধবারও ফোনে ইউক্রেনে বোমা, গুলির শব্দ ও যুদ্ধের অবস্থা নিয়ে কথা হচ্ছিল। ভীতিকর পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন হাদিসুর। বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল তার কথায়।

“ফোনে ভাই বলেছিল, আমাদের আর ভাঙ্গা ঘরে থাকতে হবে না। বাড়িতে এসেই যেভাবে হোক ঘরের কাজ ধরবে,” বলেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের ছাত্র তারেক।

বেতাগী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান ফোরকান জানান, এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন হাদিসুর। কোর্স শেষ করে তিনি ২০১৮ সালে এমভি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে ওঠেন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে।

গত ২৬ জানুয়ারি ভারতের মুম্বাই বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশের পতাকাবাহী ও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজটি। তুরস্কের একটি বন্দরে পণ্য খালাস করে পৌঁছায় ইউক্রেইনের ওলভিয়া বন্দরে।

জাহাজে ২৯ জন বাংলাদেশি নাবিক ও প্রকৌশলী ছিলেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি তাদের ‘সিমেন্ট ক্লে’ নিয়ে ইতালিতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেদিনই রাশিয়া ইউক্রেইনে আক্রমণ শুরু করলে পরিস্থিতি বদলে যায়। আটকা পড়ে বাংলার সমৃদ্ধি।

হাদিসুর রহমানের পরিবারে চলছে শোকের মাতম

ইউক্রেইনে চলমান যুদ্ধ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন জাহাজের নাবিকরা। বুধবার টেলিফোনে সে কথাও বলেছিলেন হাদিসুর।তার পরিবারও ছিল দুশ্চিন্তায়।

বৃহস্পতিবার হাদিসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বাড়ি ভর্তি মানুষ। বাকরুদ্ধ হাদিসের বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রতিবেশীরা। এখন হাদিসের লাশ ফেরার অপেক্ষা করছেন তারা।

হাদিসের ভাই তারেক বলেন, “এক নজরের জন্য হলেও আমার ভাইয়ের লাশটা শুধু দেখতে চাই। ভাইকে হারিয়ে আমাদের পরিবার পথে বসে গেল।”

জাহাজে থাকা বাকি ২৮ জন অক্ষত রয়েছেন বলে জানান বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমডোর সুমন মাহমুদ সাব্বির।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছেন, জাহাজে খাবারসহ অন্যান্য রসদ পর্যাপ্ত রয়েছে। জাহাজের সঙ্গে তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।

আর নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বৃহস্পতিবার ঢাকায় সংবাদিকদের বলেছেন, হাদিসুরের মরদেহ আপাতত জাহাজেই সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কীভাবে জাহাজের সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়, সেজন্য কূটনৈতিক উপায় খোঁজা হচ্ছে। 

আরও খবর