গীতা কর: মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনরক্ষাই ছিল তার ‘প্রতিশোধের অস্ত্র’

একাত্তরের মার্চ। বাবা আর কাকাকে পাকিস্তানি দোসররা হত্যার পর ‘প্রতিশোধের স্পৃহা’ থেকেই নিয়েছিলেন সামরিক প্রশিক্ষণ; তবে পরবর্তীতে রাইফেল হাতে ময়দানে যুদ্ধ না করলেও রাজবাড়ীর গীতা করের যুদ্ধটা ছিল অন্যরকম, মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনরক্ষার ব্রত।

ফরিদপুর প্রতিনিধিশেখ মফিজুর রহমানি শিপন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 March 2022, 03:43 AM
Updated : 2 March 2022, 04:09 AM

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একমাত্র ফিল্ড হাসপাতালে কাজ করেছেন এই নারী; কিন্তু সেই কাজের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৪৯ বছর।

গীতা করের সঙ্গে কথা হয় রাজবাড়ী শহরের সজ্জনকান্দায়। সেখানেই অবসর জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। তার আগে প্রায় আড়াই দশক ঢাকায় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) চাকরি করেছেন।  

যুদ্ধকে এখনও বিভীষিকা মনে হয় গীতার। ১৯৭১ সালে তার বয়স তখন ১৭। ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর রাজবাড়ীতেও পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন বিহারি ও রাজাকাররা মানুষ হত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ শুরু করে। আতঙ্ক নিয়েই রাজবাড়ী সদর উপজেলার বানিবহ গ্রামের বাড়িতে ছিল গীতাদের যৌথ পরিবার।

একদিন চোখের সামনেই কাকাকে হত্যা করে বিহারি ও রাজাকাররা। তারপর আর যেন শোক প্রকাশের অবসরটুকুও ছিল না; লাশ দাহ তো দূরের কথা!

একাত্তরের স্মৃতি হাতড়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে গীতা কর বলেন, “কাকার লাশ পড়ে রইল। বাড়ির উঠানে লাশ রেখে বাবা আমাদের চার বোন আর বিরাট পরিবারের সদস্যদের জীবনরক্ষার জন্য এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়লেন। আমরা এসে উঠলাম মামাবাড়ি সদর উপজেলার এড়েন্দা গ্রামে।

“তখন পাকিস্তানি সেনারা দিনের বেলায় গ্রামে গ্রামে ঢুকে পড়ছে; তাদের সহায়তা দিচ্ছে রাজাকাররা। আমরাও এক ধরনের আতঙ্ক নিয়েই মামাবাড়ি ছিলাম। সেখানে মামাদের পরিবারের লোকজনও ছিল। কিন্তু আমাদের শেষ রক্ষা হলো না।”

গীতা কর বলেন, “একদিন রাতে বিহারি ও বাঙালি রাজাকাররা মামাবাড়ি লুটপাট করতে আসে। সেসময় বাবা জিতেন্দ্র করকেও হত্যা করে তারা। বাবার লাশ ফেলে সেই রাতে পরিবারের বাকি সদস্যদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। টানা নয় দিন হেঁটে শিকারপুর বর্ডার পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছাই। সেখানে এক আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় নেই।

“একদিকে তখন বাবা-কাকাকে হারানোর বেদনা; আর আরেকদিকে মনের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা। ভারতেই দূর সম্পর্কের এক দাদার সঙ্গে কথা বলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য আমি আর আমার ছোট বোন ইরা কর নাম লিখাই। সাতজন নারী নিয়ে নকশালবাড়ীতে সেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু হয়।”

এই ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণসহ প্রাথমিক চিকিৎসার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যেই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায়। নানাজনই সেখানে প্রশিক্ষণ দিতে আসতেন। কিন্তু তাদের কখনও জানানো হয়নি, তাদের কোথায় পাঠানো হবে বা কী দায়িত্ব দেওয়া হবে।

গীতা কর বলেন, “অক্টোবর মাসের দিকে পথপ্রদর্শক হিসেবে অবাঙালি একজনকে দিয়ে আমাদের মাঠে পাঠানো হলো। তখনও আমরা জানি না কোথায় যাব। তবে একটা উত্তেজনা ছিল যে আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি। আমরা হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে করে আসাম যাই। তারপর ওই ব্যক্তিও আমাদের নির্দেশনা দিয়ে চলে যায়। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা সীমান্তের করিমগঞ্জের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছাই।

“ওই ক্যাম্পে থাকা মাখন সোম আমাদের কাছ থেকে বিস্তারিত শোনেন; তারপর খাবার খাইয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। সকালে মাখন সোম কলকাতায় আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর কাছে একটি টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রামের উত্তর না আসা পর্যন্ত সবাই ওই ক্যাম্পেই ছিলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই একটি টেলিগ্রাম আসে। ওই টেলিগ্রামের নির্দেশনা অনুযায়ী, আমাদের আগরতলা নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কুমিল্লা সীমান্তে বিশ্রামগঞ্জ নামের একটি জায়গায় মুক্তিবাহিনীর জন্য ৪৮০ বেডের হাসপাতাল ছিল। সেখানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন সেতারা বেগমের (পরে বীর প্রতীক) সাক্ষাৎ পাই। তারা আমাদের হাসপাতালের কাজে লাগিয়ে দেন।”

গীতা কর বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রুষার দায়িত্বের কথা শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। কারণ, আমরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমরা গণহত্যার প্রতিশোধ নেব- এটাই ছিল তখন মনোভাব। যুদ্ধের ময়দানে লড়ব। আমি তাদের বললাম, আমি মাঠের যুদ্ধে যেতে চাই। কিন্তু তারপরও আমাদের হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রুষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটা আমি মানতে পারিনি। মনে আছে, খুব কেঁদেছিলাম। শুধু মনে হচ্ছে, আমার যুদ্ধে যাওয়া হলো না। 

“পরে অবশ্য অনেক ভেবে দেখলাম, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করাটাও কম কথা নয়। সবাই আমাকে বোঝালেন। যুদ্ধের সময় এই সুযোগটা কজনে পায়। মনটাকে শক্ত করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় লেগে গেলাম। হাসপাতালটিতে দিন দিন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আহতদের কারও হাত উড়ে গেছে, কারও পা নেই। একটু সুস্থ হয়েই আহত মুক্তিযোদ্ধারা আবারও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ভাবি, আমি হয়তো বাবা-কাকা হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারিনি। কিন্তু যাদের সেবা করছি, তারা তো দেশকে স্বাধীন করে সেই হত্যার প্রতিশোধ নেবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত হাসপাতালেই ছিলাম।”

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরদিন ১৭ ডিসেম্বর ক্যাম্প থেকে অনেকেই দেশের দিকে রওনা দিলেও গীতা করসহ কয়েকজন সেখানে থেকে গেলেন। হাসপাতালে তখনও কিছু আহত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। পরে ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি কুমিল্লার সোনামুড়া সীমান্ত দিয়ে স্বাধীন দেশে প্রবেশ করেন গীতা ও ইরা দুবোন।

দীর্ঘদিন পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। দুবোন ফিরে গেলেন রাজবাড়ীর গ্রামের বাড়িতে। ততদিনে বাড়ি লুট হয়ে গেছে। ঘর-দরজা ভাঙা; তার মধ্যেই পরিবারের ১২ সদস্য মাথা গুজে আছে। বাবা-কাকা মারা যাওয়ায় আয়ের সংস্থান নেই, সবার জন্য দুবেলা দু-মুঠো ভাত জোগাড় করাই তখন দুঃসাধ্য। গীতা পরিবারের সন্তানদের মধ্যে সবার বড়, তার দায়িত্ব বেশি। কী করবেন- ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি।  

এর মধ্যেই একদিন জানতে পারলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করায় তাদের সনদ দেবেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী। এটা শুনে মনটা ভালো হয়ে গেল। এর কিছুদিন পর পেলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চিঠি। দেশ গড়তে কাজে নেমে পড়তে হবে, সেই কাজের জন্যই ডেকেছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পরিবারের সদস্যদের কথা ভেবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসে কাজে যোগ দিলেন। সেখান থেকে অবসরে যান ১৯৯৬ সালে। পরিবারের সবার কথা ভাবতে গিয়ে আলাদা করে আর নিজের জন্য সংসার গড়া হয়নি গীতা করের।  

এজন্য আফসোস নেই গীতার। দেশ স্বাধীন করতে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখা আর বোনদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন – এটাই বড় তৃপ্তি।

মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৪৯ বছর পর গীতা কর ২০২০ সালে পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। বয়সের কারণে শরীরে নানা রোগব্যাধি বাসা বাঁধছে। বাকি জীবনটুকু তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষকে উজ্জীবিত করে কাটিয়ে দিতে চান।  

আরও পড়ুন