১৯৭১: লুটের অস্ত্রে যুদ্ধ শুরু

১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল, দুপুর ছুঁইছুঁই। যুদ্ধের মধ্যেও নেত্রকোণা মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয় আর আদালত চত্বরে ভিড়। তার মধ্যেই মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) আর মহকুমা পুলিশ প্রধানের (এসডিপিও) মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে জিম্মি করেন মুক্তিযোদ্ধারা, লুটে নেন তিন শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র আর ৭২ হাজার গুলি; যা দিয়ে প্রতিরোধ-যুদ্ধ শুরু হয় জেলায়।

লাভলু পাল চৌধুরী নেত্রকোণা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2022, 07:55 AM
Updated : 1 March 2022, 09:01 AM

ছাত্রলীগের কয়েকজন অসম সাহসী নেতার পরিকল্পনায় এই মিশনে অংশ নেন মোট ২১ জন; যাদের সঙ্গে পরে যুক্ত হন আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকে জেলার মুক্তিযুদ্ধের ফ্রন্টলাইন।

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরে এসে সেই ২১ জনের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই; কেউ কেউ বয়সের ভারে ন্যুব্জ, অনেকে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে সেই যুদ্ধের অনেক তথ্যও আজ বিস্মৃত।

সেই যোদ্ধাদের মধ্যে তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতা মো. শামছুজ্জোহা, হায়দার জাহান চৌধুরী আর আইয়ুব আলীর বর্ণনায় উঠে এসেছে সেই অস্ত্র লুটের কাহিনি।

শুক্র, শনি ও রোববার তিন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বসেছিল নেত্রকোণা শহরের তেরিবাজারের সেক্টর কমান্ডার ফোরামের জেলা কার্যালয়ে। তাদের সেই বয়ানই এখানে তুলে ধরা হলো।

জেলা কৃষি ফার্ম; অস্ত্র লুটের পরিকল্পনার একটি স্থান।

অস্ত্র লুটের পরিপ্রেক্ষিত

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার প্রকাশের দিন মহকুমা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস অংশের নেত্রকোণা মহকুমার দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য মো. শামছুজ্জোহা ঢাকায় ছিলেন। তিনি পরদিন ইশতেহার নিয়ে নেত্রকোণায় চলে আসেন। এই ইশতেহার গোপনে ও ক্ষেত্রবিশেষে প্রকাশ্যে জনসাধারণ, অফিস-আদালতে বিতরণ করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

তখন ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ’ পরিস্থিতি। এই অবস্থার মধ্যে হামলা হলে কীভাবে প্রতিরোধ করা হবে সেটা নিয়েই ভাবছে সবাই। ঠিক এই অবস্থার মধ্যেই আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের পরিকল্পনা করেন শামছুজ্জোহা। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি মহকুমা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে গোপন বৈঠক চালান।

কৃষি ফার্ম, শামছুজ্জোহা, হায়দার জাহান চৌধুরী, নেত্রকোণা পৌর চেয়ারম্যান এনআই খান ও ছাত্রলীগ নেতা (বর্তমান সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলী খান খসরুর বাসা, মোক্তারপাড়া খেলার মাঠ, শিশু পার্ক (বর্তমানে সাধারণ গ্রন্থাগার), নেত্রকোণা পৌর মহাশ্মশানে এসব বৈঠক হতো। এসব বৈঠকে অন্যদের মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা খন্দকার আনিছুর রহমান, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বুলবুল, আইয়ুব আলীও অংশ নিতেন।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মহকুমা শহরে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সকাল–বিকাল বিক্ষোভ মিছিল করেন। তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের অসহযোগ আন্দোলন তুঙ্গে।

২৩ মার্চ মোক্তারপাড়া খেলার মাঠে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন পৌর চেয়ারম্যান এনআই খান। তখন ছাত্রলীগের নেতারা ‘গার্ড অব অনার’ দেন।  সেদিন পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো হয়।

নেত্রকোণা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়; এখানে এনেই রাখা হয় লুটের অস্ত্র।

২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যার খবর পরদিন নেত্রকোণায় ছড়িয়ে পড়ে। দলীয় নেতাকর্মী, ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। নেত্রকোণা-ময়মনসিংহ সড়কে গাছ কেটে দেওয়া হয় ব্যারিকেড। এর পর থেকে অস্ত্র সংগ্রহের তাগিদ বাড়তে থাকে।

শামছুজ্জোহার নেতৃত্বে প্রথমে সরকারি ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু হয় অস্ত্র সংগ্রহ। প্রথমে কৃষি খামারের সরকারি একটি রিভলভার, একটি দুনলা বন্দুক, পশু চিকিৎসকের একটি রাইফেল ছিনিয়ে আনা হয়। মুসলিম লীগ নেতা খোরশেদ চৌধুরীর একটি একটি রিভলবার ও একটি রাইফেল, খালেদাদ চৌধুরীর দোনলা একটি দুনলা বন্দুক নিয়ে আসেন ছাত্রলীগের নেতারা। এ ছাড়া ছাত্রনেতা খন্দকার আনিছুর রহমানের বাবা খন্দকার আব্দুল আওয়ালের পিস্তলসহ আরও কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়।

এরই মধ্যে খবর আসে, ময়মনসিংহের খাগডহরে ইপিআর ক্যাম্পের অস্ত্র লুট করেছে মুক্তিকামী জনতা। সেখান থেকে লুটের ১০টি রাইফেল ও ১০০ গুলি সংগ্রহ করে নেত্রকোণায় নিয়ে আসেন শামছুজ্জোহা।

এরপর সরকারি অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুটের পরিকল্পনা করেন ছাত্রলীগ নেতারা। এর অংশ হিসেবে শামছুজ্জোহা গোপনে কথা বলেন মহকুমা আনসার কমান্ডার আলী উছমান তালুকদার, কমান্ডার আমজাদ হোসেন ও মাইন উদ্দিনের সঙ্গে। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে তাদেরকে অস্ত্র লুটের মিশনে যুক্ত করা হয়। যুক্ত করা হয় মহকুমা পুলিশ প্রধানের (এসডিপিও) কার্যালয়ের সদস্য, কোতোয়ালি থানার বেশকিছু পুলিশ সদস্যকেও। 

১১ এপ্রিল রাত ১০টায় ছাত্রলীগের নেতা ও কয়েকজন আনসার সদস্য শহরের মোক্তারপাড়ার একটি বাসায় গোপন বৈঠকে বসেন। এই বাসাটি কেন্দুয়া উপজেলার হারুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সাত্তারের। প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠক চলে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় পরদিন জেলা অস্ত্রাগার লুট করা হবে। তার আগে অস্ত্রের মুখে মহকুমা প্রশাসক আব্দুল হামিদ চৌধুরী (এসডিও) ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা (এসডিপিও) মো. ইছহাককে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করা হবে। মিশনের খুঁটিনাটি সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, মোট ১১ জন এই মিশনে অংশ নেবেন। প্রতিরোধ হলে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য সবাই মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার শপথও নেন। 

নেত্রকোণা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়।

জানবাজির ছয় ঘণ্টা

পরদিন ১২ এপ্রিল সকাল ৯টায় সশস্ত্র অবস্থায় ১১ জন অবস্থান নেন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে। আড়াই ঘণ্টা পর বেলা সাড়ে ১১টায়  আদালতের পুলিশ কার্যালয় পরিদর্শনে আসেন এসডিপিও মো. ইছহাক। তখন শামছুজ্জোহা গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। পরিকল্পনা মতো, তিনি এসডিপিওকে আন্দোলন বিষয়ে আলোচনার কথা বলে নিয়ে যান এসডিওর কক্ষে।

কক্ষে ঢুকে বসার পর  শামছুজ্জোহার কাছে এসডিপিও জানতে চান, কী বিষয়ে আলোচনা করবেন আর কেন করবেন? ঠিক তখনি, শামছুজ্জোহা এসডিওর টেবিলে রাখা টেলিফোনের তারটি ছিঁড়ে ফেলেন। কোমরে থাকা রিভলবার বের করে শামছুজ্জোহা দুজনের দিকে তাক করেন আর হাত উপরে তুলতে বলেন। এতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান এসডিও ও এসডিপিও। নির্দেশ না মানলে গুলি করার হুমকি দেন শামছুজ্জোহা।

সঙ্গে সঙ্গে কক্ষের বাইরে সশস্ত্র অবস্থান নেওয়া হায়দার জাহান চৌধুরী, আশরাফ আলী খান খসরু, খন্দকার আনিছুর রহমান, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বুলবুল, আইয়ুব আলীসহ ১০ জন কক্ষে ঢুকে পড়েন এবং দুজনকে জিম্মি করে ফেলেন।  তখনও বাইরে এসব কেউ জানেন না।

দুই কর্মকর্তাকে জিম্মি করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও আনসার সদস্যরা শত শত জনতার মাঝ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে চলে আসেন শহরের ছোটবাজারের আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে। এই খবর পেয়ে দলীয় কার্যালয়ে ছুটে আসেন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংগ্রাম পরিষদের  আহ্বায়ক প্রাদেশিক পরিষদের (এমপিএ) আব্দুল খালেক, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান খান, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আব্বাছ আলী খান, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আবদুল মজিদ তারা মিয়া, জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) সাদির উদ্দিন।

দলীয় কার্যালয়ে আনার পর ছাত্রলীগ নেতারা দুই কর্মকর্তার কাছে অস্ত্রাগারের চাবি ও অস্ত্রাগারের সব আগ্নেয়াস্ত্র দাবি করেন। পাশাপাশি পুলিশ দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা না করার আহ্বান জানান।

এক পর্যায়ে অস্ত্র বুঝে নেওয়ার লিখিত দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান খান। সেই সঙ্গে অস্ত্রাগারের চাবি দিয়ে দেন এসডিও। তখন ছাত্রলীগের নেতা ও আনসার সদস্যরা গিয়ে অস্ত্রাগার খুলে ৩৫০টি থ্রি-নট-থ্রি ও মার্ক ফোর রাইফেল, ৭২ হাজার গুলি লুট করে ছোটবাজারের নেত্রকোণা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে চলে আসেন। বেলা আড়াইটার দিকে সম্পন্ন হয় অস্ত্র লুট।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শামছুজ্জোহা, হায়দার জাহান চৌধুরী ও আইয়ুব আলী (বাম পাশ থেকে)

মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র

অস্ত্রাগার লুটের খবর সেদিনই চলে যায় উপর মহলে। পরদিন ১৩ এপ্রিল নেত্রকোণায় বিমান হামলা চালানো হয়। ১৪ এপ্রিল শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে সদর থানার রৌহা ইউনিয়নের মহাদেবপুর গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল মান্নানের বাড়িতে নেওয়া হয় লুটের সব অস্ত্র।

শামছুজ্জোহা বলেন, অস্ত্র লুটের পরপরই বিমান হামলা চালায় পাকসেনারা। তবে সেদিনের সেই বিমান হামলার নিশানা ভুল করে তারা। বালিকা বিদ্যালয়ে রাখা অস্ত্র ধ্বংস করতে পারেনি। পরদিনই আমরা ট্রাক ও পিকআপে করে বালিকা বিদ্যালয় থেকে অস্ত্র নিয়ে যাই মান্নানের বাড়িতে। সেখানে এক রাত রাখার পর ১৫ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ইপিআর সদস্যদের স্থাপিত পূর্বধলার জারিয়া মাদ্রাসায় অস্থায়ী ক্যাম্পে অস্ত্রগুলো নিয়ে যাই। সেখানে ইপিআরের সুবেদার মেজর আজিজুল হকের কাছে সব অস্ত্র ও গুলি বুঝিয়ে দেই। অস্ত্র হস্তান্তর করার সময় এনআই খান, আব্বাস আলী খান, ফজলুর রহমান খান উপস্থিত ছিলেন।

সেই অস্ত্র তিনটি স্থানে যায় বলে জানান আইয়ুব আলী। তিনি বলেন, জারিয়া মাদ্রাসার অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে অস্ত্রের একটি অংশ গাড়িতে করে দুর্গাপুর হয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের বাঘমারা ইয়ুথ ক্যাম্পে। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন নেত্রকোণা পৌরসভার  চেয়ারম্যান এনআই খান।

কিছু অস্ত্র যায় সীমান্তের রংড়া বিএসএফ ক্যাম্পে। পরে সেখানে স্থাপিত ইয়ুথ ক্যাম্পের দাযিত্বে ছিলেন আব্বাস আলী খান।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাদির উদ্দিন, আব্দুল খালেক, আব্দুল মজিদ তারা মিয়া (উপরে বাম থেকে) আব্বাস আলী খান, ফজলুর রহমান খান, এন আই খান (নিচে বাম থেকে)।

“বাকি অস্ত্র আমিসহ আরও কয়েকজন মিলে কংস ও সোমেশ্বরী নদী দিয়ে নৌকায় করে নিয়ে যাই সীমান্তের মহাদেও ইয়ুথ ক্যাম্পে। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন আনিছুর রহমান খান। আর তিনটি ইয়ুথ ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানে ছিলেন আব্দুল মজিদ তারা মিয়ার“, যোগ করেন আইয়ুব আলী।

হায়দার জাহান চৌধুরী বলেন, “শামছুজ্জোহার নেতৃত্বে অস্ত্র লুট হয়। ধাপে ধাপে এগুলো হয়েছে। লুট করা অস্ত্রশস্ত্র তিনটি ক্যাম্পে পৌঁছার পর তা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে এই অস্ত্র, গুলি ব্যবহার করেন মুক্তিযোদ্ধারা।“

এসডিও আব্দুল হামিদ চৌধুরী এখনও জীবিত আছেন। তিনি রাজধানীর গুলশানে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য বেশ কয়েকবার মোবাইল ফোনে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। 

শামছুজ্জোহা পরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের জেলা সভাপতি তিনি।