বগুড়ার পোড়াদহ মেলায় এবার নেই বাঘাইড়

বাঘাইড় মাছ ছাড়া এবার বগুড়ার পোড়াদহে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

জিয়া শাহীন বগুড়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Feb 2022, 04:40 PM
Updated : 9 Feb 2022, 05:44 PM

‘মহাবিপন্ন’ এই মাছ মেলায় আনতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় অন্যান্য মাছ নিয়ে বুধবার পোড়াদহের ইছামতি নদীর তীরে দিনব্যাপী এই মেলা চলে।

বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার পূর্বে গাবতলী উপজেলার পোড়াদহ এলাকায় প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ বুধবারে এই মেলা বসে।

মেলার স্থান গাবতলীর মহিষাবানে হলেও পাশের সারিয়াকান্দি, ধুনট, শাজাহানপুর এবং বগুড়া সদরেও উৎসবের আমেজ থাকে। পোড়াদহ থেকে শুরু করে মেলা দাড়াইল বাজার, দুগাহাটা স্কুল মাঠ, কালিমাবাদ স্কুল মাঠ এবং আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।  

মেলাকে ঘিরে স্থানীয়রা জামাই মেয়ে এবং আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করেন। ঐতিহ্য অনুযায়ী মেলার পরদিন শুধু নারীরা মেলায় কেনাকাটা করেন।

নামে মাছ মেলা হলেও এখানে নানা রকম মিষ্টিসহ নিত্য ব্যবহারের খাট, হাড়িপাতিল, বাঁশ ও বেতের ঝুড়ির দোকান বসে।

প্রায় ‘৬০ বছর’ যাবত মেলায় বাঘাইড় মাছের ব্যবসা করছেন বলে জানান গাবতলী উপজেলার রানীরপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ মন্ডল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছোট বেলা থেকে মেলা দেখে আসছি। জীবনে এই প্রথম বাঘাইড় মাছ ছাড়া পোড়াদহ মেলা দেখতে হলো। কিন্তু সরকার নিয়ম করেছে, বাঘাইড় মাছ বিক্রি করা যাবে না। নিয়ম মেনেই এবার বাঘাইড় মাছ নিয়ে আসিনি। আমরা মেলা উপলক্ষ্যে বাঘাইড় মাছ আমদানি করেছিলাম। কিন্তু বিক্রি করতে পারলাম না। মেলায় বেশি বিক্রি হতো বাঘাইড় মাছ। অনেকেই বিভিন্ন জেলা থেকে এসে মাছ কিনতে না পেরে ফিরে গেছে।”

নওগার মান্দা উপজেলা থেকে মেলায় এসেছিলেন সঞ্জয় কুমার। তিনি বাঘাইড় মাছ কেনার জন্য এসেছিলেন; কিন্তু মেলায় বাঘাইড় মাছ না পেয়ে একটি রুই মাছ কেনেন।

“আফসোস, বাঘাইড় মাছ পেলাম না,” বলেন সঞ্জয়।

পোড়াদহ মেলায় মাছ ছাড়া মিষ্টির সুনামও রয়েছে। এ মেলায় হরেক রকমের মিষ্টি নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। এসব মিষ্টির নামও হয়ে থাকে বাহারি।

মিষ্টির দোকানি আব্দুল মোমিন জানান, এবার সবচেয়ে বড় মিষ্টি তোলা হয়েছে ইলিশ। ওজন প্রায় ১০ কেজি হবে। দাম ধরা হয়েছে প্রতি কেজি ৫০০ টাকা। এ ছাড়াও বালিশ মিষ্টি, চমচম, রসগোল্লা ইত্যাদি রয়েছে।

মেলা ঘুরে দেখা যায়, শত বছরের পুরোনো এ মেলায় শুধু মাছ, মিষ্টি বিক্রি হয় না, ঘর সংসারের প্রায় সব কিছুই মেলায় ওঠে।

খাট, হাড়িপাতিল, বাঁশ ও বেতের ঝুড়ি। মেলার এক পাশে সারিবদ্ধ হয়ে পাঁচটি নাগরদোলা বসেছে। পাশাপাশি চরকিও বসানো হয়েছে। শিশু থেকে তরুণ বয়সের সবার এই এলাকায় ভিড় বেশি।

মেলা আয়োজক কমিটির সদস্য শহিদুল ইসলাম জানান, ছোট বড় মিলিয়ে এবার পোড়াদহ মেলায় ৬০০টি দোকান বসেছে। প্রতিবার এমনি হয়।

নিষেধ অমান্য করে চলল মেলা বগুড়ার কয়েকশ বছরের ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা এক ঘণ্টার মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দেয় জেলা প্রশাসন। কিন্তু জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মেলা চলমান থাকে।

পোড়াদহের মেলায় ২২ কেজি ওজনের কাতলা মাছ হাতে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টায় এক বিক্রেতা। মাছটির দাম তিনি হেঁকেছেন ৫৫ হাজার টাকা।

বুধবার বেলা ১১টার দিকে মেলায় উপস্থিত হয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে মেলা বন্ধ করতে বলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সালাহউদ্দিন।

এ সময় তার সঙ্গে গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রওনক জাহানসহ অন্য কর্মকর্তারা ছিলেন। প্রশাসনের এই দলটি আধঘণ্টা মেলায় অবস্থান করে। দলটি কয়েকটি মাছের দোকান বন্ধ করার কথা বলে ফিরে চলে যায়। এরপর আবার আগের মতো স্বাভাবিকভাবে মেলা চলে।

মালিয়ানডাঙ্গা গ্রামের রিপন প্রামানিক বলেন, ঈদে কোনো আত্মীয়-স্বজন কিংবা প্রবাসী আসতে না পারলেও পোড়াদহ মেলা উপলক্ষ্যে চলে আসে। পোড়াদহ মেলাটি একটি উৎসব।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সালাহউদ্দিন বলেন, বগুড়ায় করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনক। এই কারণে জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে মেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাই এক ঘণ্টার মধ্যে দোকানের মালামাল নিয়ে মেলা ত্যাগ করতে বলা হয়।

গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা  রওনক জাহান বলেন, করোনা সংক্রমণের কারণে এবার মেলার কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। অনুমিত উপেক্ষা করেই সাধারণ জনগণ এই মেলায় আয়োজন করেছেন।

“আমরা মেলায় গিয়ে তাদের নিষেধ করেছি। এক ঘণ্টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে।”

এবার সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় মেলায় বাঘাইড় মাছ নেই; তবে অন্যান্য মাছ রয়েছে বলে ইউএনও জানান।

ইউএনও বলেন, গত ২৪ জানুয়ারি বনপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের এক বিজ্ঞপ্তিতে বাঘাইড় মাছকে মহাবিপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাঘাইর মাছ একটি মহাবিপন্ন প্রাণী। তাই ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে অনুষ্ঠেয় পোড়াদহ মেলায় মহাবিপন্ন বাঘাইর ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হলো।

বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী মেলায় মহাবিপন্ন বাঘাইর ক্রয়-বিক্রয় করা হলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

মহিষাবান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ জানান, প্রায় ৪০০ বছর আগে মেলাস্থলে ছিল একটি বিশাল বটবৃক্ষ। সেখানে একদিন হঠাৎ এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। পরে সেখানে আশ্রম তৈরি করেন সন্ন্যাসীরা। এক পর্যায়ে স্থানটি পুণ্যস্থানে পরিণত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে। প্রতিবছর মাঘের শেষ বুধবার ওই স্থানে সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। সমাগত হয় দূর-দূরান্তের ভক্তরা। কালের আবর্তে স্থানটিতে লোকজনের উপস্থিতি বাড়তেই থাকে। এভাবে গোড়াপত্তন ঘটে পোড়াদহ মেলার।

তিনি জানান, মেলাটি বসে সাধারণত একদিনের। কিন্তু মেলার পরের দিনে বউ মেলাও বসে। এ সময় সাধারণত নারীরা তাদের হরেক রকেমর পণ্য কিনে থাকে।