মামলা থাকবে না: শাবির আন্দোলন নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী

আন্দোলন চলাকালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো থাকবে না জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, ‘পেছনে যা কিছু ঘটে গেছে, সেগুলো আর থাকবে না’।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Jan 2022, 03:16 PM
Updated : 26 Jan 2022, 03:34 PM

বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙার পর সন্ধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী সরকারি বাসভবনে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন।

এতে বিশ্ববিদ্যালয় শিগগির খুলে দেওয়া, আন্দোলন ছাত্রদের একাডেমিক বিষয়ে কোনো প্রভাব ফেলবে না এবং মামলা তুলে নিতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান সব সমস্যার সমাধানে কাজ করার কথা জানান তিনি।

তবে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের বিষয়ে তিনি সরাসরি কিছু বলেননি।

শাবিতে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগে গত ১৩ জানুয়ারি রাতে আন্দোলনে নামেন ওই হলের শিক্ষার্থীরা।

এরপর আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহে পুলিশের ধাওয়া ও লাঠিপেটায় ক্যাম্পাসের অন্তত অর্ধশত লোকজন আহত হন। সে ঘটনায় পুলিশ ‘গুলি বর্ষণ ও হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিটের অভিযোগ’এনে অজ্ঞাতপরিচয় ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করে।

এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অর্থ জোগান দেওয়ার অভিযোগে মঙ্গলবার ঢাকায় সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।

পরে তাদের সিলেট পুলিশে হস্তান্তর করা হয়, যারা বুধবার জামিন পেয়েছেন।

মঙ্গলবার রাতে জালালাবাদ থানায় দায়ের করা মামলায় পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও এক থেকে দেড়শ জনকে আসামি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

মামলা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার কথা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সমস্যাই যখন থাকছে না, যারা এ মামলাগুলো করেছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেও যা কিছু করার আমরা করব।

“মামলা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব। শিক্ষার্থীদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়, সেটি নিশ্চিত করব।”

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “যা কিছু ঘটে গেছে, আমরা তো সামনের দিকে এগোতে চাইছি। আমরা পেছনে দেখতে চাই না। পেছনে যা কিছু ঘটে গেছে, সেগুলো আর থাকবে না।

“একাডেমিক কোনো কিছুতে এর কোনো প্রভাব থাকবে না। মামলা থাকবে না, কোনো অসুবিধা নেই।“

দীপু মনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের যত অভিযোগ রয়েছে, তাতে কারও অবহেলা বা ত্রুটি থাকলে তাদের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।”

বুধবার সকাল ১০টা ২৫ মিনিটের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই শিক্ষক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হক পানি পান করিয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান।

এজন্য জাফর ইকবালকে আন্তরিক ধন্যবাদ শিক্ষামন্ত্রী।

অধ্যাপক জাফর ইকবাল দম্পত্তি গত মঙ্গলবার ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে ভোরে শাবিতে পৌঁছান। তারা অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলোচনার পর শিক্ষার্থীদের অনশনে ইতি টানতে রাজী করান।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, সেটা হচ্ছে- আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের অবরোধ কর্মসূচি তুলে নেবেন, তারা আন্দোলনের ইতি এখানে টানবেন।

“এর অর্থ যে, তারা এখন আর আন্দোলন করবে না। কিন্তু তারা যে কারণে আন্দোলন করেছেন, সেই কারণগুলো সেই সমস্যা আমরা সমাধান করব।”

শিক্ষার্থীদের একটি হলের কিছু অসন্তোষ ও দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল বলে উল্লেখ করে দীপু মনি বলেন, “তিন দিনের মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে… সেখানে দুঃখজনক পুলিশি অ্যাকশনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। তারপরে এই পুরো আন্দোলনটি এক দফার আন্দোলনে পরিণত হয়।

“যে কারণে কয়েক দফার আন্দোলন এক দফায় পরিণত হল, তার পরবর্তীতে যে ঘটনাপ্রবাহগুলো ঘটেছে, সে বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখব। সেখানে যদি কারও ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে, অবহেলা থাকে, তার সবকিছুবই খতিয়ে দেখা হবে।

“তিনি বা তারা যেই হোক না কেন-তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।” 

যে সমস্যাগুলো নিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সে সমস্যাগুলো দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে মন্তব্য করেন তিনি।

“বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের নানা সমস্যা রয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সুষ্ঠুভাবে চলার জন্য, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকার জন্য এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং সমাধান করা খুব জরুরি।”

শাবির শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলন’ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

“…তবে উপাচার্যের ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়, তখন আমরা খুব উৎকণ্ঠায় ছিলাম যে এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন একটি ভিন্ন দিকে চলে যায় কিনা। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত, শিক্ষার্থীরা আমাদের সঙ্গে সমস্যার সমাধানে আলাপ-আলোচনা করবে। একযোগে কাজ করবে।”

বিশ্ববিদ্যালয়টি শিগগির খুলে দেওয়া হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

কবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা হবে এমন প্রশ্নে দীপু মনি বলেন, “যারা অনশন করেছে, আন্দোলন করেছে, সেসব শিক্ষার্থীরা শারীরিক, মানসিক ও আবেগের দিক থেকে পর্যুদুস্ত অবস্থায় আছে। তারাও একটু গুছিয়ে উঠুক, সুস্থ হয়ে উঠুক। যদি তারা চান, আমরা খুব শীঘ্রই যেতে পারি। যদি কয়েকটা দিন পরে চান, সেটাও যেতে পারি।”

তিনি বলেন, “এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে অভাব, অভিযোগ, অসন্তোষ রয়েছে, সে অসন্তোষ, মূল সমস্যার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আমরা শুধু বহিঃপ্রকাশ দেখতে চাই না। আমরা মূল সমস্যার সমাধান দেখতে চাই। সেই সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আমরা সবাই একদিকে। আমরা সবাই মিলে সমস্যাগুলোকে সমাধান করব।”

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, গণরুম ও খাবারের সমস্যা সমাধান করার কথা বলেন তিনি।

“আমি আশা করছি, এর মধ্য দিয়ে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার অনেকখানি সমাধান করতে পারব।”

উপাচার্য পরিবর্তন হবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “একজন উপাচার্য থাকছেন কি, থাকছেন না, সমস্যা সমাধানে সেটার প্রভাব থাকছে না। একজন উপাচার্য চলে গেলে আরেকজন আসলে যদি সমস্যাই থেকে গেল, তাহলে তাদের তো কোনো লাভ হল না।

“উপাচার্যের বিষয়ে, এর তো নানান পদ্ধতি আছে, দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি তার ওপর এই দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। এই প্রক্রিয়াটাকে আমরা ভিন্নভাবে দেখব। এই দাবির বিষয়ে আমাদের আলোচনা, আমরা সমস্যার সমাধান করব। এরপর আমরা দেখব, আমাদের পক্ষে কী করা সম্ভব?”

বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে গত ১৩ জানুয়ারি রাতে আন্দোলনে নামেন ওই হলের শিক্ষার্থীরা।

এর জেরে পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেডে শিক্ষার্থীসহ ক্যাম্পাসের অন্তত অর্ধশত লোকজন আহত হন।

সে ঘটনায় পুলিশ ‘গুলি বর্ষণ ও হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিটের অভিযোগ’এনে অজ্ঞাতপরিচয় ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করে।

তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে উল্টো উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।

একপর্যায়ে তারা অনশনে যান। উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

সাতদিন পর সেই অনশন ভাঙালেন জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন হক।