সেতু একটি, স্বপ্ন পাহাড়ের তিন উপজেলার

ছয় দশক ধরে দাবির পর চেঙ্গি নদীর উপর একটি সেতুকে ঘিরে রাঙামাটির দুর্গম তিন উপজেলার মানুষ যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য আর পর্যটন ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।

ফজলে এলাহী রাঙামাটি প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Jan 2022, 02:44 PM
Updated : 11 Jan 2022, 02:44 PM

২০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় এই সেতুটি বুধবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন বলে নানিয়ারচর উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে।  

মঙ্গলবার বিকালে নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিউলি রহমান তিন্নী গণমাধ্যমকে বলেন, সকাল ১০টায় সেতুটি উদ্বোধনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সেতুর তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ান (ইসিবি)। এখনও সেতুটির নামকরণ করা হয়নি।

ইউএনও আরও জানান, বুধবার নানিয়ারচরের সাপ্তাহিক হাট বসে। কিন্তু সেতুর উদ্বোধনের কারণে হাটটি একদিন পিছিয়ে বৃহস্পতিবার বসবে।

১৯৬০ সালে হ্রদ সৃষ্টির পর থেকেই চেঙ্গী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিল স্থানীয় অধিবাসীরা। রাঙামাটি সদর-নানিয়ারচর-লংগদু-বাঘাইছড়ি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ১৯৯৩ সালে নানিয়ারচর অংশে চেঙ্গী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এখানে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন।

দুই বছর পর ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সেতু নির্মাণ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে ইসিবি। এর কার্যাদেশ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনিকো লিমিটেড।

সেতুটির দৈর্ঘ্য ৫০০ মিটার ও প্রস্থ ১০ দশমিক ২ মিটার। সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সেতুর দুই পাশে দুই কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ ব্যয় হয়েছে আরও ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণের কাজে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনিকো লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার পাল বলেন, বছরখানেক আগেই এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। স্থানীয়দের যাতায়াতের সুবিধার্থে সেতুটি খুলেও দেওয়া হয়েছে। বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করবেন।

সেতুটি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হওয়ায় তারা খুশি। তবে এখনই এই সেতুর সুবিধা পুরোপুরি পাচ্ছে না লংগদু ও বাঘাইছড়ির মানুষ। কারণ, নানিয়ারচর থেকে লংগদু উপজেলায় যাতায়াতের ১৮ কিলোমিটার দুর্গম পাহাড়ি সড়ক এখনও নির্মাণ হয়নি। সেটি নির্মাণ হলেই লংগদুর সঙ্গে জেলা সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে।

এ ছাড়া বাঘাইছড়ি উপজেলার মানুষ এখন খাগড়াছড়ি হয়ে রাঙামাটি যাতায়াত করেন। এই ১৮ কিলোমিটার সড়ক হয়ে গেলে বাঘাইছড়ির মানুষও দীঘিনালা-লংগদু হয়ে সরাসরি জেলা সদরে আসতে পারবে। এতে সময়, অর্থ আর শ্রম বাঁচবে।

নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমা গণমাধ্যমকে বলেন, “একটি সেতুর মাধ্যমে আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। আমরা এখন খুব সহজেই জেলা সদরে নৌপথ ছাড়াই যাতায়াত করতে পারব। এ ছাড়া উপজেলায় উৎপাদিত পণ্য পরিবহন ও বাজারজাতকরণে ভোগান্তি কমে আসবে। আস্তে আস্তে এর সুফল পেতে শুরু করবে পাশের লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলার মানুষ।”

লংগদু উপজেলার বাসিন্দা আবু দারদা খান বলেন, নানিয়ারচরে সেতু নির্মাণের সুফল তিন উপজেলার মানুষ পাবেন; এটা সত্য। কিন্তু সেটি কিছুটা সময়সাপেক্ষ। এখন নানিয়ারচর বাজার থেকে রত্নাকুর বনবিহার পর্যন্ত রাস্তাটি পাকা। পরের রাস্তাটি কাঁচা।

এ ছাড়া লংগদু-দীঘিনালা সংযোগ সড়ক থেকেও নানিয়ারচর যাওয়ার পথটি মাত্র এক-দুই কিলোমিটারের মতো সম্পন্ন হয়েছে; তাই এখনই সব সুফল মিলবে না বলেও জানান আবু দারদা।

বাঘাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দীন বলেন, “আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাঘাইছড়ির সঙ্গে রাঙামাটির সরাসরি সড়ক যোগাযোগ। নানিয়ারচর সেতুটি নির্মাণের ফলে আমরা এই লক্ষ্যে আরেক ধাপ অগ্রসর হলাম। বাঘাইছড়ির মানুষের এখন খাগড়াছড়ি হয়ে রাঙামাটিতে আসা-যাওয়া করতে হয়। কিন্তু বাঘাইছড়ি থেকে লংগদু উপজেলা যাওয়ার রাস্তাটির কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে।”

নানিয়ারচর উপজেলার বাসিন্দা শিক্ষার্থী উৎস দেবনাথ বলেন, “আগে আমরা নদী পার হতে ভোগান্তির শিকার হতাম। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর খেয়াঘাট পার হতে অনেক ভোগান্তি হতো। মাঝিদের ডেকে এনে রাতে ঘাট পার হতে হতো। বাজারের ওপাড়ের মানুষের অসুস্থ রোগী, মৌসুমি ফল, শাক-সবজি পরিবহনে অনেক কষ্ট করতে হতো। সেতুটি হওয়ায় এখন অনেক সহজ হয়েছে।”