বানারীপাড়ায় বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামে গত সপ্তাহে ওই জমি দখলের সময় বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) আসনের সংসদ সদস্য শাহে আলম উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
তবে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি এই সংসদ সদস্য দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মেয়ে মেঘনা গুহঠাকুরতা সম্প্রতি ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিলে বিষয়টি আলোচনায় আসে।
তিনি লিখেছেন, “সংসদ সদস্য মো. শাহে আলম (বানারীপাড়া-উজিরপুর) দাঁড়িয়ে থেকে আমার ৫ শতাংশ জমি, যাহার বাজার মূল্য কোটি টাকা, তা বালিকা বিদ্যালয়ের নামে দখল করে নিয়েছে।”
এরপর যোগাযোগ করলে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কাকাত ভাই প্রফুল্ল গুহের ছেলে ও জমির মালিক দাবিদার অনুপ কুমার গুহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের দুই ভাইয়ের (অনুপ গুহ ও পল্লব গুহ) নামে বানারীপাড়া মৌজায় ২৫৯ নম্বর খতিয়ানের ৫২৫ নম্বর দাগে ১৩ শতাংশ জমি ছিল।
এই সম্পত্তি বানারীপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশেই এবং সেখান থেকে আট শতাংশ জমি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের জন্য জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণ করে।
অনুপ বলেন, “অবশিষ্ট পাঁচ শতাংশ জমি গত ৩০ ডিসেম্বর বিকালে সংসদ সদস্য শাহে আলমের উপস্থিতিতে দখল করে নিয়েছে তার আশ্রিত লোকজন ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। “আমি বাধা দিতে গেলে সংসদ সদস্য শাহে আলম আমাকে হুমকি-ধমকি দেন। তাই প্রাণের ভয়ে আমি ঘরে ফিরে গেলে, তারা জমিতে থাকা পুরাতন ভবনটি ভেঙে টিনের বেড়া দিয়ে বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয়নি।”
তিনি বলেন, “২০১২ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি পরিপত্র দেখিয়ে বানারীপাড়া পৌরসভা কর্তৃপক্ষ এই জমি নিজেদের দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তখন আমরা হাই কোর্টে একটি রিট করি। পরে ২০১৪ সালে হাই কোর্ট এ ব্যাপারে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেয়।”
ওই জমি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বানারীপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক।
তিনি বলেন, “জমি দখল করা হয়েছে এই অভিযোগ সঠিক নয়। বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের পাশে ইউনিয়ন পরিষদের বহু বছর আগের একটি পুরনো ভবন ছিল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ হবে, তাই ভবনটি ভেঙে ফেলছে কর্তৃপক্ষ। ফলে বিদ্যালয়ের নিরাপত্তার স্বার্থে রাস্তার পাশ থেকে টিনের বেড়া দেওয়া হয়েছে।”
প্রধান শিক্ষক বলেন, “মালিকানা দাবিদার অনুপদের এখানে আড়াই থেকে তিন শতাংশ জমি থাকতে পারে। শুনেছি, এই জমি তারা বিক্রি করবেন। এটা বালিকা বিদ্যালয়, জমি অন্য কারও কাছে বিক্রি করলে মেয়েদের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।”
অনুপরা রাজি থাকলে ওই জমি কিনে নিতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগ্রহী বলে জানান প্রধান শিক্ষক।
এক প্রশ্নের জবাবে আবু বকর সিদ্দিক বলেন, “জমিতে বেড়া দেওয়ার সময় বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও সংসদ সদস্য শাহে আলম কিছুক্ষণ উপস্থিত থাকলেও কাউকে তিনি হুমকি-ধমকি দেননি।”
এ বিষয়ে বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য শাহে আলম বলেন, “আমি কাউকে হুমকি-ধমকি দেইনি। কেনই-বা হুমকি দিতে যাব? জনপ্রতিনিধিদের কাজ হুমকি দেওয়া নয়।”
তিনি বলেন, “জমি তো আমার নামে নিয়ে যাইনি। জমিটুকু বিদ্যালয়ের প্রধান গেটের পাশে হওয়ায় এর সঙ্গে ছাত্রীদের নিরাপত্তা জড়িত। তাই সেখানে বেড়া দেওয়া হয়েছে।
“আমি তখন উপস্থিতও ছিলাম না। সেখান থেকে আসা-যাওয়ার পথে বেড়া দিতে দেখেছি। জমির মালিক তারা হলে বাজারমূল্য অনুযায়ী তাদের জমির দাম বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হবে।”
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অনুপ গুহ বলেন, “আমাদের বাবা, দাদাদের (পূর্ব পুরুষ) ভারতের ভবানীপুরে সম্পত্তি ছিল। দেশ ভাগের সময় তারা ভারতে ফিরে না যাওয়ায় ভবানীপুরের জমির পরিবর্তে বানারীপাড়ায় তাদের সম্পত্তি দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াকে এখন ‘এওয়াজ বদল’ বলে। তখন বলা হত ‘ফ্যামিলি অ্যারেজমেন্ট’। তখন লিখিতভাবেই জমির এওয়াজ বদল হয়।
“এরপর আমাদের পরিবার এই জমিতে বসবাস করে আসলেও রেজিস্ট্রি করা হয়নি। ১৯৭৭ সালে বাবা জমি রেজিস্ট্রি করেন।”
ভবানীপুরের জমির সঙ্গে বানারীপাড়ার জমির ‘এওয়াজ বদল’র কোনো প্রমাণপত্র আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই কাগজ আদালতে জমা দিয়েই বাবা জমি রেজিস্ট্রি করেছিলেন। তাই এওয়াজ বদলের কাগজ আমাদের কাছে এখন নেই।”
অনুপ গুহ’র বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সংসদ সদস্য শাহে আলম বলেন, “দেশভাগ হয়েছে ১৯৪৭ সালে। আমার প্রশ্ন তখন রেজিস্ট্রি না করে, ৩০ বছর পরে কেন জমির রেজিস্ট্রি করলেন অনুপের বাবা? মূলত সরকারি জমির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে মামলার মাধ্যমে বৈধতা নিয়েছে তারা।”
এর পাল্টায় অনুপ বলেন, “এক দাগে ১৩ শতাংশ জমির মধ্য থেকে ৮ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের জন্য জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণ করেছে। আমি অধিগ্রহনের টাকা-পয়সাও বুঝে পেয়েছি। কাগজপত্রে ভেজাল থাকলে তো সরকার এই জমি অধিগ্রহণ করত না।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন কুমার সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জেলা প্রশাসন যখন একই মালিকের জমি অধিগ্রহণ করেছে, তা হলে এই জমির কাগজপত্রে সমস্যা নেই বা থাকার কথা নয়।”