এমন কয়েকজন অভিযান প্রিয় তরুণ-তরুণী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অভিযানে নেমেছেন; শেষ করেছেন বান্দরবানের বগালেক থেকে কেউক্রাডং ট্রেকিং। বগালেক থেকে কেওক্রাডং পর্যন্ত ট্রেকিং করে (হেঁটে) ১৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টার মতো। দ্রুত হাঁটলে সময় কিছু কমানো যায়।
কয়েকটি দলের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের দেখা হয়, যারা তাদের অভিযানের কথা, স্বপ্নের কথা বলেছেন অকপটে।
বারোজনের একদল তরুণ-তরুণী এসেছেন সিলেট থেকে; সবাই সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থী।
পাহাড়ের পথ পাড়ি দিতে কেমন লাগে প্রশ্ন করা হলে দলের সদস্য ফিমা বলেন, “এটাই চ্যালেঞ্জ, এটাই মজা, এটাই আনন্দ। আমরা সবাই বগালেক থেকে কেওক্রাডং পর্যন্ত হেঁটে পাহাড় উঠব সিদ্ধান্ত নিয়েই এখানে এসেছি। আমাদের ১২ জনের দলে আটজন ছেলে এবং চারজন মেয়ে রয়েছে। সবারই এখানে প্রথমবার আসা।
“কষ্ট যত হবে হোক, বগালেক থেকে কেওক্রাডং পর্যন্ত হেঁটে এসেছি। পরদিন সকালে আবার হেঁটেই বগালেক ফিরব। হয়তো বা কখনও বান্দরবানে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া হবে। কিন্তু প্রথমবার পাহাড় ট্রেকিং করার এ অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি জীবনেও ভুলব না। কষ্টকর, কিন্তু এক কথায় অসাধারণ।”
ওই দলের জুননু রাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুধু ট্রেকিং এর জন্যই কষ্ট করে এখানে আসা। কষ্ট না করলে এ আনন্দ পাওয়া যেত না। গাড়িতে করে এলে ট্রেকিংয়ে যে একটা আলাদা ব্যাপার আছে সেটা বুঝতাম না। পাহাড়ে উঠতে উঠতেই শারীরিক পরিশ্রম ও কষ্ট ভুলে যাচ্ছি।”
তাদের দলের তোহা নামের আরেকজন বলেন, ‘‘আমাদের দলের সবাই সমানতালে হাঁটতে পারে না। কয়েকজন বার বার পেছনে পড়ে যায়। তাদেরকে অপেক্ষা করে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। দুর্বল লাগলে হালকা পানি খেয়ে বিশ্রাম নিলে আবারও ভালো হাঁটা যায়। সময় একটু বেশি চলে চলে যায় আরকি।’’
এই পর্যটকদলের মতো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেকিং করতে কেওক্রাডং পাহাড়ে আসেন ভ্রমণপ্রিয় লোকজন। এর জন্য সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই চার মাস সময়কে বেছে নেন তারা।
বগালেক হয়ে কেওক্রাডং পাহাড় এখন তাই ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের পছন্দের জায়গা। ট্রেকিং করে যাওয়ার সময় এ পথে চোখে পড়বে উঁচুনিচু পাহাড়, আঁকাবাঁকা পথ আর ঝিরি ঝরণা। দেখা মিলবে পাহাড়িদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারাও। পেরোতে হবে বনজঙ্গল আর ছোট ছোট ঝোপঝাড়।
পাহাড় ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের টানে ট্রেকিং করতে এসেছেন বলে জানালেন ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী দল। সে দলের চারজন তারেক আজিজ, হাসনাইন ইলাহি, আখজার শাকুর ও শিহাব আহমেদ এসেছেন দ্বিতীয়বার।
হাসনাইন ইলাহি বলেন, “কষ্ট করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড়ে ওঠা একটা ফিলিংস দেবে। মনের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্ম দেবে। অনেকেরই মনে হবে জীবনে কিছুই হয়নি। কিন্তু এখানে এসে এরকম সর্বোচ্চ পাহাড়ে ওঠা একটা বড় অর্জন বলে মনে হবে।”
আখজার শাকুর বলেন, “ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে এখানকার প্রকৃতিকে অনুভব করতে আসি। তবে দুঃখজনকভাবে বগালেকের মত জায়গায় কিছু কৃত্রিম অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, যেটা এখানকার পরিবেশের সঙ্গে একেবারেই মানানসই না। আর্র্টিফিসালি যখন কিছু করা হয় তখন স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে।
“এখানে প্রকৃতি যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকুক। এটাই মানুষকে আকৃষ্ট করবে। প্রকৃতিকে যারা ভালোবাসে; এখানে যা আছে তা দেখতেই মানুষ বারবার ছুটে আসবে।
বগালেক থেকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে রওনা দেওয়ার পর রাস্তার পাশে ছোট ছোট টংঘর পাওয়া যায়। স্থানীয় পাহাড়ি লোকজন ট্র্যাকারদের জন্য লেবুর শরবত, পাকা পেঁপে, আখ ও রং চা বিক্রি করে সেখানে। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত পর্যটকরা এসব খেয়ে আবার তরতাজা হয়ে নেন।
জোয়াল এন কিম বম নামে একজন দোকানি বলেন, “পর্যটন মৌসুমে টং ঘর দোকান স্থানীয়দের জন্য কিছু বাড়তি আয়ের পথ তৈরি করেছে। বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার ভালো পর্যটক আগমন ঘটে। এ সময় প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মতো বিক্রি হয়। তবে বাকি দিনগুলোতে এক হাজার টাকার বেশি বিক্রি হয় না।“
ভ্রমণের আনন্দ বাড়াতে গিটার কাঁধে নিয়ে ট্রেকিং করে বগালেকে ফিরছিলেন পাঁচজনের একটি দল। টং ঘরে বিশ্রাম নেওয়ার সময় গিটার বাজিয়ে গান ধরেন সুজন মেহেদী নামে একজন। তার গিটারের সুর যেন পাহাড়ের গায়ে লেপটে একাকার হয়ে যায়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মেহদেী বলেন, “পাহাড় ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে একটা গিটার নিয়ে যাই। দিনের বেলায় এ পাহাড় ও পাহাড় ঘোরাঘুরির পর রাতে জমিয়ে গানের আড্ডা হয়। এগুলো পাহাড়ে না এসে অনুভব করা যায় না। পাহাড় ও প্রকৃতিকে ভালবাসার মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ আছে।”
প্রত্যেকটি পর্যটক দলে পথ প্রদর্শক হিসেবে একজন করে স্থানীয় গাইড রয়েছে। গাড়ি ভাড়া করা, রুম বুকিং দেওয়া এবং খাবার অর্ডার দেওয়াসহ পর্যটকদের নানা সহযোগিতা দিয়ে থাকেন তারা।
প্রদীপ বলেন, “অনেকে অভিভাবক ও আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে একটা অপরিচিত জায়গায় বেড়াতে আসে। তাদের সুবিধা অসুবিধা খুব দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দেখতে হয়। থাকা খাওয়া থেকে শুরু করে ঘুমানো পর্যন্ত তাদের পাশে থাকতে হয়। এখানে শুধু গাইড হিসেবে নয়, একজন অভিভাবকের মতো করে দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়।‘’
১৮ বছর ধরে পর্যটক গাইডের কাজ করে আসা রাহাত উল্লাহ বলেন, “ ট্রেকিং করতে আসা পর্যটকদের অনেক দর্শনীয় স্থানেও নিয়ে যাই। এখানে যারা আসে তাদের অধিকাংশই পাহাড় ও প্রকৃতি দরদী মানুষ।”
রুমা উপজেলা পর্যটক গাইড সমিতির তথ্য মতে বান্দরবানের রুমা উপজেলা সদর থেকে খোলা জিপ (চাঁদের গাড়ি), ল্যান্ড ক্রুজার ও মোটরসাইকেলে করে সরাসরি কেওক্রাডং পর্যন্ত যাওয়া যায়। বগালেক পর্যন্ত পিচঢালা রাস্তা হলেও কেওক্রাডং পাহাড় পর্যন্ত রাস্তা এখনও কাঁচা। কাদা মাটির অবস্থার কারণে বর্ষাকালে যে কোনো ধরনের গাড়ি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ থাকে। এ সময় কোনো পর্যটকও যায় না সেখানে।
রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা [ইউএনও] মোহাম্মদ মামুন শিবলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এসব এলাকায় প্রকৃতি প্রেমীরাই বেশি ঘুরতে আসে। কেওক্রাডং এলাকায় পর্যটকদের থাকার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে কটেজ নির্মাণ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন এখনও কোনো অবকাঠামো করেনি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বগালেকের পাশে পর্যটকদের বসার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। বগালেকের প্রাকৃতিক পরিবেশ সুন্দর রাখতেই প্রশাসন আর কোনো অবকাঠামো তৈরি করেনি।
পর্যটন মৌসুমে রুমা উপজেলায় কত পর্যটক আসে প্রশ্ন করা হলে ইউএনও বলেন, এর নির্দিষ্ট হিসাব তাদের কাছে নেই। আগামীতে উপজেলা প্রশাসেনর উদ্যোগে পর্যটকদের নিবন্ধন করা হবে।