মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ সেই সুরাইয়া কোলে চড়ে স্কুলে যাচ্ছে

মাগুরায় মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ সেই সুরাইয়াকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে।

মাগুরা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Jan 2022, 02:08 PM
Updated : 7 Jan 2022, 02:58 PM

শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় গত রোববার সকালে মা নাজমা বেগমের কোলে চড়ে প্রথম স্কুলে যায় সে।

সুরাইয়াকে মাগুরা পুলিশ লাইন্স সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে বলে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রোকসানা আক্তার জানান।

তবে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করালেও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তার মা-বাবা। সেইসঙ্গে সরকারিভাবে উন্নত চিকিৎসার দাবিও জানান তারা।

মা নাজমা বেগম অভিযোগ করেন, “দেশের মন্ত্রী, এমপিসহ বড় কর্তা ব্যক্তিরা সুরাইয়ার চিকিৎসা ও লেখাপড়াসহ সারাজীবনের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। কেউ তাকে ডাক্তার আবার কেউ ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লেখাপড়ার দায়িত্ব দূরে থাক, এখন কেউ তার খোঁজ-খবর পর্যন্ত রাখেন না। তাই বাধ্য হয়েই পারিবারিক উদ্যোগে তাকে মাগুরা পুলিশ লাইন্স সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে।”

সুরাইয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে নাজমা বেগম বলেন, “গুলির আঘাতে সুরাইয়ার দুই পায়ের শক্তি হারিয়েছে। ডান চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। বাম চোখের অবস্থাও ভালো না। চিকিৎসক জানিয়েছেন – ডান চোখে আর দেখতে পাবে না সে। উন্নত চিকিৎসা না করালে বাম চোখও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।”

তিনি দুঃখ করে বলেন, সুরাইয়ার সমবয়সী বাচ্চারা এখন দৌড়ে বেড়ালেও সে এখন দাঁড়াতেও পারে না। হাত ধরে দাঁড় করিয়ে ছেড়ে দিলেই সে পড়ে যায়। এর মধ্যে তার গলায় একটি টিউমারও ধরা পড়েছে। তার ডান পাশে জোর কমে যাচ্ছে। উন্নত চিকিৎসা করাতে পারলে সে ভালো হয়ে যাবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের সেই অর্থনৈতিক ক্ষমতা নেই।

“তারপরও স্কুলে ভর্তি করেছি, কারণ তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। তবে প্রতিদিন তাকে কে স্কুলে নিয়ে যাবে সে নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি।”

সুরাইয়ার বাবা চা দোকানি বাচ্চু ভুঁইয়া বলেন, সুরাইয়ার জীবনে যে ঝড় বয়ে গেছে তা তিনি কখনও ভুলতে পারবেন না।

“ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়ায় তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। জানি না তার লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে কি না। কারণ সে শরীরিক নানা জটিলতায় আক্রান্ত। সরকারিভাবে তাকে চিকিৎসার জন্য নানা ব্যক্তির কাছে ধরনা দিলেও কেউ তার উন্নত চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়নি।”

এদিকে ঘটনার ছয় বছরেও বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রাকাশ করে তার বাবা এই মামলার দ্রুত বিচার দাবির পাশাপাশি সরকারিভাবে সুইরাইয়ার উন্নত চিকিৎসারও দাবি জানিয়েছেন।

মাগুরা জজ আদালতের পিপি এস্কেন্দার আজম বাবলু বলেন, “দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট আদালতে বিচারক না থাকায় মামলাটির বিচারকাজ বিলম্বিত হয়েছে। এখন সে সমস্যা সমাধান হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

মা নাজমা বেগম ও সুরাইয়া

সরকারপক্ষ এ মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করার জন্য অত্যন্ত আন্তরিক বলে জানান তিনি।

মাগুরা জেলা প্রশাসক আশরাফুল আলম জানান, সুরাইয়ার জন্য তার বাবা-মা চিকিৎসা, শিক্ষা, খাদ্য ও বস্ত্র সংক্রান্ত সহায়তা চাইলে তিনি তা দিতে প্রস্তুত। কারণ এ ধরনের সহায়তার জন্য সরকারি বরাদ্দ রয়েছে।

২০১৫ সালের ২৩ জুলাই মাগুরা শহরের দোয়ারপাড়ে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সমর্থক দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে মমিন ভূইয়া নামে একজন নিহত হন। এছাড়া সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন এক পক্ষের নেতা কামরুল ভূইয়ার ভাবি অন্তঃসত্ত্বা নাজমা বেগম। পরদিন গুলির ক্ষত নিয়েই জন্ম হয় সুরাইয়ার।

এ ঘটনায় ২৫ জুলাই মোমিন ভুইয়ার ছেলে রুবেল ছাত্রলীগ নেতা সুমন সেনকে প্রধান আসামি করে সদর থানায় ১৬ জনের নামে মামলা করেন। মামলার আসামিদের মধ্যে আজিবর নামে একজন এরই মধ্যে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন।

তদন্ত শেষে এজাহারভুক্ত এক আসামির নাম বাদ ও নতুন তিন জনের নাম যোগ করে পরবর্তীতে ১৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

২০১৭ সালের মার্চে মামলা থেকে অব্যাহতি চাওয়া পাঁচ আসামির আবেদন খারিজ করে অভিযোগভুক্ত ১৭ আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন বিচারক।

মামলার অভিযুক্তরা হলেন- সুমন সেন, আলী আকবর, মুজিবুর রহমান, সুমন আলী, ফরিদুর রহমান, সাগর, বাপ্পী গাজী, ইলিয়াস মোল্যা, সোহেল মিয়া, লিটন মল্লিক, মিল্টন মল্লিক, নজরুল ইসলাম, সোবহান শেখ, সোলায়মান হোসেন, তৈয়বুর রহমান তোতা, মো. সুমন ও আয়নাল শেখ।