ফেলানী হত্যার ১১ বছর: বিএসএফের অমিয়র শাস্তি চায় পরিবার

কুড়িগ্রাম সীমান্তে আলোচিত ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার ১১ বছরেও না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে পরিবার।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিআহসান হাবীব নীল, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Jan 2022, 12:37 PM
Updated : 7 Jan 2022, 12:37 PM

হত্যার বার্ষিকীতে নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের দক্ষিণ কলোনীটারি গ্রামে ফেলানীর বাড়িতে শুক্রবার বাদ জুমা পারিবারিকভাবে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও প্রতিবেশীরা অংশ নেন। পরিবারের সদস্যরা আবারও এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার দাবি করেন।  

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বিয়ের উদ্দেশে ভারত থেকে বাবার সঙ্গে দেশে ফেরার পথে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানী। ফেলানীর লাশ কাঁটাতারে চার ঘণ্টার বেশি সময় ঝুলে ছিল। মর্মস্পর্শী এই দৃশ্য তখন সারাবিশ্বেই সমালোচনা তৈরি করে।

সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে ফেলানীর মা জাহানারা বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, ”ফেলানীকে ওর খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার উদ্দেশে ভারত থেকে নিয়ে আসছিল ফেলানীর বাবা। কিন্তু বিএসএফের গুলিতে আমার মেয়ে কনের সাজে না সেজে সাদা কাপড়ে সেজে দুনিয়া থেকে চলে গেল।”

”আমার মেয়ের মুখটিও শেষবারের মতো দেখতে পারিনি। মা হিসেবে যে কী কষ্ট বুঝাতে পারব না। গুলি লেগে কাঁটাতারে ঝুলে ছিল। পানি পানি করে চিৎকার করলেও আমার ফেলানীর মুখে পানি পড়েনি।”

এ ঘটনার আসামি ও বিএসএফের সদস্য অমিয় ঘোষের ফাঁসি দাবি করে জাহানারা বেগম বলেন, “তাইলে আমার এবং ফেলানীর আত্মা শান্তি পাবে।”

অমিয় ঘোষের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন ফেলানীর বাবা নুর ইসলামও। তিনি বলেন, ”আমার চোখের সামনেই মেয়েকে হত্যা করেছে অমিয় ঘোষ। কিন্তু আমি আজও ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার পাইনি। আমি ন্যায়বিচার চাই।”

এ মামলায় সহায়তাকারী হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবী ও কুড়িগ্রাম জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলী (পিপি) এস এম আব্রাহাম লিংকন।

তিনি বলেন, “ফেলানীর রক্ত বৃথা যায়নি। ফেলানী হত্যার আগে সীমান্তে ‘ট্রিগার ফ্রি’ ছিল। এখন বিএসএফ গুলি করলে জবাবদিহিতার মুখে পড়ে। আগে যেমন নিত্য খুন-খারাপি ছিল সেটা কমে এসেছে। এটা একটা আমাদের প্রাপ্তির জায়গা বলে মনে করি।”

”কিন্তু ফেলানী হত্যা ঘিরে ন্যায়বিচার পাইনি, আমরা সেটার অপেক্ষায়। এ ছাড়া সীমান্ত হত্যা পুরোপুরি বন্ধ করতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে,” যোগ করেন আব্রাহাম লিংকন।

এ সময় লিংকন আরো জানান, করোনার কারণে ভারতের আদালতের শুনানি থমকে আছে। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ করোনা শুরুর আগে শুনানির দিন ধার্য হলেও তা হয়নি এখনও।

নূর ইসলাম পরিবার নিয়ে থাকতেন ভারতের আসাম রাজ্যের বোয়াইলপাড়া জেলার বঙ্গাইগাও এলাকায়। ২০১১ সালে কিশোরী ফেলানীর বিয়ে ঠিক হয় বাংলাদেশে। বিয়ের উদ্দেশে বাবার সঙ্গে দেশে ফিরছিল ফেলানী।

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফুলবাড়ীর উপজেলার অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে বাবা নুর ইসলামের সঙ্গে মই দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া টপকিয়ে বাংলাদেশে ফেলার সময় বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় ফেলানী। নুর ইসলাম বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নেমে রক্ষা পান। ফেলানীর নিথর দেহ কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে ছিল। এ হত্যাকাণ্ডে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমসহ মানবাধিকার কর্মীদের মাঝে সমালোচনার ঝড় উঠলে ২০১৩ সালের ১৩ অগাস্ট কোচবিহারে বিএসএফের বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যার বিচারকাজ শুরু হয়। সেখানে ফেলানীর বাবা ও মামা হানিফ সাক্ষ্য দেন।

২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাদ দেয় ভারতের কোচবিহারের সোনারী ছাউনিতে স্থাপিত বিএসএফের বিশেষ আদালত। পুনঃবিচারের দাবিতে ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে ভারত সরকারের নিকট আবেদন করেন। পরে বিজিবি-বিএসএফের দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে ফেলানী হত্যার পুনঃবিচারের সিদ্ধান্ত হয়।

২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনঃবিচার শুরু করে বিএসএফ। ওই বছরের ১৭ নভেম্বর ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম বিএসএফের বিশেষ আদালতে অমিয় ঘোষকে অভিযুক্ত করে পুনরায় সাক্ষ্য প্রদান করেন এবং অমিয় ঘোষের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। ২০১৫ সালের ২ জুলাই এ আদালতে অমিয় ঘোষ আবারও বেকসুর খালাস পান।

২০১৫ সালের ১৩ জুলাই ভারতীয় ‘মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ’ (মাসুম) ফেলানী খাতুন হত্যার বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন করে। ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর শুনানীর পর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে বারবার তারিখ পিছিয়ে যায়।

ফলে থমকে গেছে ফেলানী খাতুন হত্যার বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি।