ঘোড়া সহজ করে দেয় সাকসিং বমের জীবন

উঁচু-নিচু পাহাড়, যেখানে হাঁটা-চলাই দায়, তবু জীবনের তাগিদে বহন করতে হয় মালপত্রও। সেই কাজ ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে জীবন খানিকটা সহজ করে নিয়েছেন বান্দরবানের সাকসিং বম।

উসিথোয়াই মারমা বান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Jan 2022, 08:47 AM
Updated : 7 Jan 2022, 08:47 AM

জেলার রুমা উপজেলার রেমাক্রিপ্রাংসা ইউনিয়নের দার্জিলিং পাড়ার বাসিন্দা সাকসিং বম একজন চাষি। তাছাড়া বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য কেনাবেচা করেন তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বছর ১৫ আগে কেওক্রাডং এলাকায় ম্রো সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতিটা ৪০ হাজার টাকা করে চারটা ঘোড়া কিনি। ঘোড়া দিয়ে অনেক দূর থেকে মালামাল বহন করে নিয়ে আসা খুব সহজ হয়ে উঠে। এরপর দেখি দিন দিন বেশ কাজে লাগে।”

কেওক্রাডং পর্বতের পাদদেশে দার্জিলিং পাড়া। পাড়াপ্রধান সাকসিং বমের বয়স এখন ৬৫ বছর।

তিনি বম ভাষায় বলেন, “বিশেষ করে বর্ষাকালে পাহাড়ি পিচ্ছিল পথে হাঁটাচলা করা খুবই কঠিন। সেখানে পিঠে থুরুং (বাঁশ ও বেতের তৈরি ঝুড়ি) লাগিয়ে বহন করতে হত সব মালামাল। জঙ্গলাকীর্ণ দূর পথ পেরিয়ে বহন করে নিয়ে আসতে হত জুমক্ষেতের সবজি। দিনের পর দিন পাহাড়ি পথে এভাবে বহন করতে হত মণকে মণ আদা ও হলুদও। কখনওবা বাগানের হরেক রকমের ফলমূল। এতে সময় লাগত বেশি।

“সেখানে একটি ঘোড়ায় দেড় থেকে দুই মণ পর্যন্ত মালামাল অনায়াসে বহন করে নিয়ে আসা যায়।“

সুবিধা দেখে পরে তিনি আরও চারটা ঘোড়া কেনেন।

সাকসিং বলেন, “আটটা ঘোড়া হয়ে যায় আমার। ঘোড়ায় করে মণকে মণ আদা হলুদ বহন করে রুমা সদর বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যেতাম। আবার সেখান থেকেও ঘোড়ায় করে নিয়ে আসতাম বিভিন্ন পণ্য।”

পরে কেওক্রাডাং থেকে রুমা বাজার পর্যন্ত রাস্তা হয়। এখন আর ঘোড়ায় করে মাল নেন না রুমা পর্যন্ত। ঘোড়া এখন ক্ষেতের কাজে এবং অন্যান্য পাহাড়ি এলাকায় ব্যবহার করেন বলে জানান সাকসিং বম।

সাকসিং বলেন, বগালেক থেকে কেওক্রাডং পাদদেশে দার্জিলিং পাড়ায় পায়ে হেঁটে যেতে লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। শুকনো মৌসুমে গাড়ি চললেও বর্ষায় কর্দমাক্ত কাঁচা রাস্তায় গাড়ি বন্ধ থাকে। তখন ঘোড়ায় করে দিনে দুইবার নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল বহন করা যায়।

বয়সের কারণে এবং রোগে ভুগে চারটি ঘোড়া মারা গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন তার পরিবারের চারটি ঘোড়া আছে।

সাকসিং বমও বয়স হওয়ায় নিজে আর ঘোড়াগুলোর দেখভাল করতে পারেন না। সম্প্রতি তার বড় ছেলে খলত্লিং বম দেখভাল করছেন ঘোড়াগুলো।

ঘোড়া লালন-পালন সম্পর্কে খলত্লিং বম বলেন, “বাবার পর আমি ছাড়া তাদের আর কেউ সামলাতে পারে না। পরিবারের অন্য কেউই তাদের কাছে যেতে পারে না। অপরিচিত কেউ গায়ে হাত দিলে লাথি মারে।

“বর্তমানে যে চারটা ঘোড়া আছে সেগুলো কেনা হয় একজন ম্রোর কাছ থেকে। সেখানে ঘোড়াগুলো ম্রো ভাষা শুনতে অভ্যস্ত ছিল। বম ভাষা বুঝত না। এ কারণে অনেকবার ঘোড়ার লাথি খেতে হয়েছে আমাকে। পরে অনেক কষ্ট করে আমাদের বম ভাষা রপ্ত করেয়েছি ঘোড়াগুলোকে।”

চারটি ঘোড়াকে চারটি নাম দিয়েছেন খলত্লিং। নামগুলো হচ্ছে- মংনিং, ব্লং, চহ্ লদি ও চিংলং।

চারটির মধ্যে একটি মর্দা আর তিনটি মাদি।

সম্প্রতি দার্জিলিং পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, পাড়ার জনবসতি থেকে দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা একটি উন্মুক্ত জায়গায় ঘোড়াগুলো রাখা হয়েছে। বাঁশের ঘের দিয়ে রাখা হয়েছে।

খলত্লিং বলেন, “ঘেঅড়াগুলোকে বলে দেওয়া হয়েছে, মালিক ছাড়া কোথাও যেন চলে না যায়। উন্মুক্ত অবস্থায় দিনের পর দিন এমনিই আছে। খাবার খেয়ে নিজেদের মত করে থাকে তারা। দরকার হলে সেখানে গিয়ে নাম ধরে ধরে ডাকলে এক এক করে আমার কাছে চলে আসে।”

মাঝে মাঝে ঘোড়াগুলো অসুখে ভোগে বলে জানান খলত্লিং।

তিনি বলেন, “প্রায় সময় পেট ব্যথা হয় ঘোড়াগুলোর। অসুস্থ হলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিষয়ক দপ্তর থেকে পরামর্শ নিয়ে ওষুধ কিনে খাওয়ানো হয়।”

ঘোড়াগুলোকে করোনাভাইরাস টিকা দেওয়া হয়েছে বলে জানান খলত্লিং।

“অসুস্থ হলে বেশি ঘুমায় ঘোড়া। খাবার খেতে চায় না। তখন গুড় ও ছোলা দেওয়া হয়। তবে জুমের মিষ্টিকুমড়া বেশি পছন্দ তাদের।”

পেটব্যথা হলে কিভাবে বোঝেন?

খলত্লিং বলেন, “হাঁটাচলা ঠিকমত না হলে বুঝতে হবে তাদের পেট ব্যথা হচ্ছে। এ সময় তাকে বিশ্রামে রাখা হয়। তবে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় দিনে-রাতে একদম ঘুমায় না তারা। ঘুম বলতে শুধু চার থেকে পাঁচ মিনিট চোখে বুজে থাকে।”

কখন কোন ঘোড়ার কী দরকার তা ঘোড়ার কিছু আওয়াজ ও আচরণ দেখতে বুঝতে পারেন বলে জানান পরিবারের আরেক সদস্য জেম হিলটন বম।

হিলটন বলেন, “ঘোড়ার পিঠে অতিরিক্ত ভারী বোঝা চাপানো হলে বা কোনো কারণে কোনো ঘোড়া বিরক্ত হলে নির্দিষ্ট কিছু শব্দ করে। আবার বিশ্রাম দরকার হলে আরেক ধরনের আচরণ করে তারা।

“তখন আমাদেরও তাদের সঙ্গে বুঝেসুঝে আচরণ করতে হয়। পায়ে কোনো আঘাত পেয়েছে কিনা অথবা কোথায় কী হয়েছে তা দেখতে হয়, বুঝতে হয়। তাছাড়া পথে চলার সময় লাঠি উঁচিয়ে দিকনির্দেশ করা হয়।”

সুযোগ হলে আরও চারটি ঘোড়া কেনার ইচ্ছে রয়েছে বলে তারা জানান।

ঘোড়ার পরিচর্যা ও যত্ন সম্পর্কে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. গোলামুর রহমান বলেন, বেশি দৌড়ালে ঘোড়ার পায়ে ফোস্কার মত হয়। পায়ে সমস্যা দেখা দেয়। তাছাড়া অনেক সময় জ্বর ও কৃমিজনিত সমস্যাও দেখা দেয়। ঘোড়ার প্রধান রোগ স্কিন ডিজিজ, কলিক পেইন ও অপুষ্টিজনিত সমস্য। এ কারণে ঘোড়ার বাসস্থান সব সময় খোলা ও উন্মুক্ত হতে হয়। বাসস্থান কোনো কক্ষে হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়। পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের জন্য দরজা ও ভেন্টিলেটর রাখতে হয়।

“ঘোড়াকে সুস্থ রাখার জন্য বিভিন্ন শাক-সবজি, ঘাস, দানাদার খাবার, ভাঙা ভুট্টা, ছোলা, ধান ও গমের ভুসি বেশি দিতে হয়।”

ঘোড়ার পায়ে দিকে সব সময় মনোযোগ রাখতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, সঠিক পরিচর্যা হলে ঘোড়া ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচে।

ঘোড়াকে সব সময় সুস্থ রাখার ব্যাপারে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

বান্দরবানে সাকসিংয়ের পরিবার ছাড়া অন্য কেউ ঘোড়া পালন করেন এমন তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গোলামুর রহমানের কাছেও এমন তথ্য নেই বলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।