জানতে চাইলে বললেন, ওখানে তার লাগেজ ছিল, কাপড়চোপড়ের সঙ্গে আইডি কার্ড ছিল, আর ছিল ৬৫ হাজার টাকা। তার মুখে শোনা গেল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়ার গল্প।
মধ্যবয়সী ওই নারী বললেন, “আগুন যখন এখানে আসছে, আমি ঘুমে ছিলাম, বিকট একটা শব্দ আসছে, আমার ছেলে ১৩ বছর বয়স, এ বছর এইটে পরীক্ষা দিছে। ওরে আমি উঠাইছি।
“ও তো লম্বা হয়ে গেছে, ওরে টাইন্না এইখান থেকে ওইখানে নিছি। মানুষ আর মানুষ। ছেলে তো সাঁতার জানে না, যখন সবাই লাফ দেয়, আমার তো লাফ দেওয়ার ই নাই, ছেলে বাঁচবে না, আমি বেঁচে কী করব?”
“আমরা দোয়া কালাম পড়ে রেডি হইছি, বাচ্চারে কোলে নিছি, আর কোনোদিন দেখা হবে না। কেয়ামতের দিন দেখা হইলে… বাবা, তোমারে ভালো রেজাল্টের জন্য কত মারছি, তুমি আমারে ক্ষমা কইরে দিও। আমার ছেলে অমারে ধইরে বসছে চুমু দিয়া, বলে ‘আম্মু, তোমারে ছাড়া বাঁচব না’।
শেষ পর্যন্ত আরও অনেকের মত নদীতে লাফ দিয়েই বাঁচতে হয়েছে মধ্যবয়সী ওই নারী আর তার ছেলের।
“আস্তে আস্তে স্রোতে ভাসতে ভাসতে লঞ্চ পারে যখন আসছে,… যখন খেলাম যে গাছ দেখা যায়, ছেলেরে বললাম যে বাবা, তুমি পানির নিচ দিয়া হাঁটবা। হাইট্টা দেখবা গাছ পাইলে গাছ ধইরা উরপে উইঠ্ঠা যাইতে পারবা।
এই দুই যাত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও বাঁচতে পারেননি অনেকেই। শুক্রবার পর্যন্ত লঞ্চ আর নদী থেকে ৩৭ জনের লাশ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা; দগ্ধ বা আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন অন্তত ৭২ জন।
সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে দক্ষিণ জনপদের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোতে ভিড় থাকে অন্য দিনের তুলনায় বেশি। সাপ্তাহিক ছুটির দুটি দিন পরিবারের সঙ্গে কাটাতে অনেকেই লঞ্চে চড়ে বসেন। তাদের অনেকেই বাড়ি ফিরছেন লাশ হয়ে।
বিআইডব্লিউটিএ বলছে, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে চারশর মত যাত্রী ছিল। তবে উদ্ধার পাওয়া যাত্রীরা বলছেন আটশ থেকে এক হাজার আরোহী থাকার কথা।
শীতের রাতে যাত্রীদের অধিকাংশই গরম কাপড়ে শরীর মুড়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। তিন তলা লঞ্চের কেবিনগুলোর দরজাও ছিল বন্ধ। রাত ৩টার পর হঠাৎ বিস্ফোরণের বিকট শব্দের পর ছড়িয়ে পড়ে আগুন।
বেঁচে যাওয়া আরেক যাত্রী আব্দুর রহিম জানান, রাতে ডেক থেকে তিনি হঠাৎ বিকট শব্দ পান। তারপর লঞ্চের পেছন দিক থেকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে দেখেন। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন পুরো লঞ্চ গ্রাস করে ফেলে। আতঙ্কিত হয়ে তিনি ডেক থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন।
দিয়াকুল গ্রামের লোকজন নৌকা নিয়ে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিচ্ছিলেন। তারাই রহিমকে উদ্ধার করে গরম কাপড় দেন। পরে সকালে তাকে ট্রলারে করে ঝলাকাঠি শহরে নেওয়া হয়।
অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে ওই লঞ্চের যাত্রীদের স্বজনরা সকালে ভিড় করেন ঝালকাঠির ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের দিয়াকুল এলাকায় সুগন্ধা নদীর তীরে; বাতাসে তখন ভাসছে পোড়া গন্ধ। সেখানে স্বজনের খোঁজ না পেয়ে অনেকে ছোটেন হাসপাতালে।
বরগুনা জেলা প্রশাসন মরদেহ সৎকারের জন্য প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে নিহতদের তালিকা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানিয়েছেন, অধিকাংশ লাশ এতটাই পোড়া যে, চেহারা দেখে পরিচয় শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যাবে।