সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য দিনভর হারভাঙা শ্রম কোনোদিন ক্লান্ত করতে পারেনি তাদের। স্বপ্ন ছিল তিন সন্তান লেখাপড়া শিখবে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এবং পরিবারের হাল ধরবে। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা নিমিষেই চুরমার করে দিল তাদের সব স্বপ্ন।
বুধবার সকাল ৮টার দিকে নীলফামারী সদর উপজেলার কুন্দরপুর ইউনিয়নে বউবাজার এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারায় এই তিন ভাই-বোনসহ চার জন।
লিমা আক্তার (৭), শিমু আক্তার (৪) ও মমিনুর রহমান (৩) তিন জনই রেজওয়ান-মজিদা দম্পত্তির সন্তান। আর ওই শিশুদের বাঁচাতে গিয়ে মারা যান একই গ্রামের সালমান ফারাজী শামীম শামীম (২৬)।
এলাকাবাসী জানায়, দুজনের শ্রমের আয়ে সন্তানদের নিয়ে ভালোই চলছিল তাদের। লেখাপড়ার জন্য বড় মেয়ে লিমা আক্তারকে ভর্তি করেছিলেন শিশু শ্রেণিতে। অন্য দুই সন্তানকেও স্কুলে ভর্তির প্রস্তুতির চলছিল তাদের।
দুর্ঘটনার পর ওই গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। একই সময়ে চার লাশের শোক যেন বহন করতে পারছিলেন না গ্রামের মানুষ।
ওই তিন শিশুর নানি হাসিনা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “তিনটা ছাওয়াক নিয়া হামেরা মেল্লা স্বপন দেখিবার শুরু করিছি। আল্লাহ যে কেনে ওমান ধরি গেইল, হামার এলা কী হইবে? ছাওয়ালার বাবা-মা এই শোক কী করিয়া পাশুরিবে, ও আল্লা এলা কী হইবে?”
সন্তান হারোনোর শোকে কাতর রেজওয়ান আলী নির্বাক হয়ে পলকহীন চোখে তাকিয়ে ছিলেন একই সঙ্গে শোয়ানো সন্তানদের মরদেহের দিকে।
তিনি বলেন, সকালে হোটেল থেকে নাস্তা এনে তিন সন্তানসহ নাস্তা খান। নাস্তা শেষে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন তারা। এর পরেই দুর্ঘটনার খবর আসে তাদের কাছে।
দুর্ঘটনার পর অসুস্থ স্ত্রী মজিদাকে ভর্তি করা হয়েছে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে।
তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, “মুই এলা কী করিম, কেমন করি বাঁচি থাকিমো হামেরা। মোর তামান স্বপন যে শ্যাষ হইল।”
“ছোট ছেলেটাকে একজনের কোলে দিয়ে আমি ওই যুবককে উঠানোর চেষ্টা করি। এর পরপরই দেখি আরও দুটি ছোট বাচ্চার দেহ পড়ে রয়েছে। আমি তখনও বুঝিতে পারিনি ওই তিন বাচ্চা আমার নাতি-নাতনি।”
তিনি আরও বলেন, তার ছেলে ও বউমা দুজনই কর্মজীবী। ছেলে রেজওয়ান পেশায় রিকশাচালক এবং বউমা একটি কারখানার শ্রমিক। প্রতিদিনের মত সকালে দুজনেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যার যার কর্মস্থলে চলে যান। দুই নাতনি ও নাতি বাড়িতেই ছিল।
“এরপর আমি তাদের বাড়িতে রেখে রেল লাইনের ধারে ক্ষেতে কাজ করতে যাই। এসময় তারা তিন ভাইবোন দাদির চোখ ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে এসে এই দুর্ঘটনার শিকার হয়। তাদের বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ যায় শামীমের।”
প্রতিবেশী মহির উদ্দীন (৫৫) জানান, তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তাদের বাবা-মায়ের। তাদের বড় করার লক্ষ্যে হারভাঙা শ্রম দিয়েই চলছিলেন দুজন। সন্তানদের নিয়ে তাদের আনন্দের কমতিও ছিল না। কিন্তু হঠাৎ একটি ট্রেন দুর্ঘটনা ভেঙে দিল পরিবারটির স্বপ্ন।