উপকূলের ‘জলবায়ু উদ্বাস্তুরা’ ভিড় করছে শহরে

খুলনার কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া নদীর চরে খাসজমিতে কোনো রকমে ঘর তুলে বাস করছেন কার্তিক মুণ্ডা। ঘর বলতে গেওয়া গাছের চারটি নড়বড়ে খুঁটির ওপর গোলপাতার ছাউনি। নদীতে জোয়ারের পানি ঢুকলে তার ঘরের বারান্দা পর্যন্ত চলে আসে পানি।

শুভ্র শচীন খুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2021, 07:39 PM
Updated : 1 Nov 2021, 07:39 PM

নৃ গোষ্ঠীর একজন কার্তিক বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এভাবেই চলছে। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে এলাকায় অভাব-অনটন প্রকট আকার ধারণ করে, কাটাতে হচ্ছে বিপর্যস্ত জীবন। এ পরিস্থিতিতে জীবিকার অন্বেষণে কেউ কেউ এলাকা ছাড়ছেন।

কয়রার সংবাদকর্মী নিশীথ রঞ্জন মিস্ত্রি জানান, দুর্যোগ কবলিত সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদের মানুষ ভাঙাগড়ার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন। একটির ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই, নতুন নামে ফের আঘাত হানছে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়।

“এসব ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বহু মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে বিপুল জনগোষ্ঠী। কাজ না থাকায় অনেকে এলাকা ছাড়ছে,” বলেন তিনি।

খুলনা নগরের ৫ নম্বর ঘাটের গ্রিনল্যান্ড বস্তির ডি ব্লকে ঘর তুলে বসবাস করছেন কয়রা উপজেলার নাকশা গ্রামের বাসিন্দা রাহেলা বেগম (৪০)। ঘূর্ণিঝড় আইলায় ঘরবাড়ি হারিয়ে সপরিবারে শহরে চলে আসেন তারা। বাসাবাড়িতে কাজ করে কোনোমতে চলছে তার সাত জনের সংসার।

‘বাস্তুহারা’ রাহেলা বলেন, আইলার পর অর্ধশত পরিবার সব হারিয়ে এ বস্তিতে বসবাস করছে। এরা প্রায় সবাই তার এলাকার। 

বস্তিটি রেলওয়ের জমিতে। প্রায়ই রেল কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ করার কথা বলে যায়। যে কারণে মাথাগোঁজার শেষ আশ্রয়টুকু হারানোর আতঙ্ক সবসময় ঘিরে থাকে রাহেলাদের। 

নগরীর সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালের পাশে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে গড়ে উঠেছে খোড়াবস্তি। বর্তমানে এ বস্তির নামকরণ হয়েছে স্থানীয় কাউন্সিলরের নাম অনুসারে হাফিজ নগর। এখানেও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩০-৪০টি ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ পরিবার বসবাস করছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতবিক্ষত সুন্দরবনের উপকূলীয় এ জনপদের মানুষ এভাবেই নিজেদের শেষ আশ্রয়- ঘরবাড়ি হারা হয়েছেন। এদেরকেই ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।

২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি কম হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এর প্রভাব পড়েছে ‘ভয়ংকরভাবে’ বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ভিড় বাড়ছে নগরীতে।

উপকূলীয় তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার এক হাজার ৬৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা নাজুক উল্লেখ করে তারা বলেন, প্রায় ৬০ বছর আগে তৈরি এসব বাঁধের এখন আর দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা নেই। যে কারণে উপকূল জুড়ে ধীরে ধীরে লবণপানি গ্রাস করায় মানুষ কাজ হারিয়ে ‘উদ্বাস্তু’ হচ্ছে। চলে আসছে শহরে। 

সংসদ সদস্য গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও নদী ভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। এতে উপকূলের মানুষের নানান ঝুঁকি বাড়ছে। এ ঝুঁকি মোকাবেলায় উপকূলের মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

খুলনা সিটি করপোরেশনের তথ্য মতে, নগরে ছোট-বড় মোট ৪০টি বস্তি রয়েছে। এসব বস্তিতেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, ‘জলবায়ু উদ্বাস্তুরা’ ঠাঁই নিচ্ছেন।

তেমনি একটি বস্তি হল নগরের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের গ্রিনল্যান্ড বস্তি। এখানে হাজারো মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে বসবাস করছেন। রেলওয়ের জমিতে গড়ে ওঠা এই বস্তিতে বসবাস করছেন একসময়ে কয়রার স্থায়ী বাসিন্দা অর্ধশত পরিবার।

এদের মধ্যে কেউ এসেছে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর, কেউ সিডরের পর, আবার কেউবা এসেছেন আম্পানের পর। তারা সবাই প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারিয়েছেন মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু। নদী কেড়ে নিয়েছে শেষ সম্বল জমি। কারও আবার জমি থাকলেও লবণাক্ততা কেড়ে নিয়েছে ফসল করার উর্বরতাটুকু।

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি, বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোংলায় এলাকায় নদীর তীর ও বেড়িবাঁধের পাশে প্রায় ২০ লাখ মানুষের বসবাস। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার নদীগুলোর আশপাশের এলাকা অনেকটাই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। মানুষ ঝুঁকি নিয়ে নদীর তীরে ও বেড়িবাঁধের পাশে নিজের জমি বা খাসজমিতে বসবাস করছেন।

তারা জানান, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু তারপরও তাদের অন্য কোথাও স্থানান্তর বা দুর্যোগ সহনশীল ঘর তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে `মাইগ্রেশন’ হওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও এসব উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ কম। তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের সুদীর্ঘ পরিকল্পনা থাকা জরুরি।

সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও নদী ভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। 

প্রকৃতির এমন আচরণের জন্য উন্নত দেশগুলোকে দায়ী করে তিনি বলেন, যাদের কারণে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে সেসব দেশের কাছ থেকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিপূরণ আদায়ে জোর দিতে হবে। একইসঙ্গে উপকূল এলাকায় দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

পরিবেশ সুরক্ষা ফোরাম খুলনার আহ্বায়ক অ্যাড. কুদরৎ ই খুদা বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাইগ্রেশন হবে, বেঁচে থাকার স্বার্থে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের সব অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এজন্য থাকা দরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা। কিন্তু এ উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের শিক্ষক অধ্যাপক তানজিল সৌগাত বলেন, প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তাদের কাছাকাছি যে শহর আছে সেখানে আশ্রয় নেয়। খুলনা শহরেও একই অবস্থা। সরকারের কাজ হলো এই মানুষদের আশ্রয় দেওয়া ও জীবিকার ব্যবস্থা করা।

তাছাড়া শহরের আশপাশের উপজেলাগুলোকে শহরের আদলে তৈরি করা হলে মূল শহরের ওপর চাপ কম পড়বে। তাহলে শহরের শৃঙ্খলা ঠিক থাকবে।

জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজিজুল হক জোয়ার্দ্দার বলেন, “শহর এলাকায় আমাদের কাজ নেই বললেই চলে। আমাদের কাজ রুট লেভেলে।

“আমরা কাজ করি প্রশাসনের সঙ্গে। আমরা মাধ্যম হিসেবে কাজ করি, বাস্তবায়ন করে প্রশাসন।“ 

কয়রার ইউএনও অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের আমরা সরকারি ও বেসরকারিভাবে পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছি। রাস্তাঘাট ও বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। যারা গৃহহারা হয়েছেন, তাদের গৃহনির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে।” 

খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে যারা শহরে এসেছে তাদের সহায়তা করতে বিভিন্ন এনজিওর সহযোগিতায় কাজ করছেন তারা। সিটি করপোরেশনেরও দারিদ্র্য মোচনের একটি কর্মসূচি রয়েছে।

খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ইসমাইল হোসেন বলেন, উপকূলীয় তিন জেলায় যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করেন, তাদের স্থানান্তর, ঘর তৈরিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।