রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়: সবার সামনেই ‘বিষপানের’ চেষ্টা!

ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন আগেই, সহপাঠীরা পাশে ছিলেন, সামনে ছিলেন শিক্ষকরাও। শতাধিক মানুষের সামনে হ্যান্ডমাইক হাতে ক্ষোভ আর হতাশার কথা বলতে বলতে পকেট থেকে একটি বোতল বের করে মুখে নেওয়ার চেষ্টা করলেন এক শিক্ষার্থী। তাকে থামানোর চেষ্টায় শুরু হল হই চই, হট্টগোল। কয়েক মিনিট পর দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্সে তুলে তাকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। 

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2021, 08:38 AM
Updated : 24 Oct 2021, 09:37 AM

রোববার বেলা ১২টার দিকে নাটকীয় এ ঘটনা দেখা গেল সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে, যেখানে চুল কেটে দেওয়ার অভিযোগে এক শিক্ষকের স্থায়ী অপসারণের দাবিতে অনশন করছেন একদল শিক্ষার্থী।  

যাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, সেই শামীম হোসেন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। শনিবার রাতে ফেসবুক লাইভে এসে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ওই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনকে স্থায়ীভাবে অপসারণ না করার বিষয়ে রোববার বেলা ১২টার মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষ না নিলে তিনি অ্যাকাডেমিক ভবনের সামনেই আত্মহত্যা করবেন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, রোববার দুপুরে অ্যাকাডেমিক ভবনের সামনে অনশনস্থলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে হ্যান্ড মাইকে কথা বলতে বলতেই বিষপানের চেষ্টা করেন শামীম।  

তার সহপাঠী জাহিদুল ইসলাম সিরাজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের দাবি না মানার কারণে শামীম আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।”

সেপ্টেম্বরের শেষে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যায়ন বিভাগের ১৬ শিক্ষার্থীর চুল কেটে দেওয়ার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান রবীন্দ্র অধ্যায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান লায়লা ফেরদৌস হিমেল জানান, তিনিসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক ঘটনার সময় কাছাকাছিই ছিলেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরাই না শুধু, উপস্থিত যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিল, ওরাও খুব আটকে ধরে… বোধহয় ওর সাথেই ছিল জিনিসটা। আমরা ভেবেছিলাম, ও যদি কিছু আনতে যায়, আমরা আটকাব। কিন্তু সম্ভবত ওর পকেটে বা কোথাও ছিল।”

শামীম আসলে কী খেয়েছেন জানতে চাইলে হিমেল বলেন, “পয়জন ছিল, সম্ভবত। আমি দেখিনি ও কী খেয়েছে, আমি দেখেছি ও মুখে কিছু দিয়েছে।”

এত মানুষ থাকার পরও তাকে আটকানো গেল না কেন- এই প্রশ্নে এই শিক্ষক বলেন, “ওরা আমাদের কথা শুনল না, ওরা বলেই দিয়েছে যে ‘আমরা শিক্ষকদের কাছে কিন্তু শুনতে চাচ্ছি না’। আমাদের হাতে তো আসলে কোনো ডিসিশন নেই। আমরা তো সিন্ডিকেট মেম্বার নই।  আমরা ওদের সান্ত্বনা দিতে পারি, কিংবা করতে পারি এটা কোরো না।

“প্রশাসনিক জায়গা থেকে ওরা আসলে কিছু শুনতে চাচ্ছিল। ভিসি মহোদয় আসেননি, রেজিস্ট্রার এসেছেন, কিন্তু উনি কোনো কথা বলবেন না। তো এই অবস্থায় এই অ্যাটেম্পটা নিল।” 

আন্দোলনকারীরা বলছেন, শামীম ঘোষণা দিয়ে রাখায় আগেই অ্যাম্বুলেস এনে রাখা হয়েছিল। সেই অ্যাম্বুলেন্সে করেই তাকে পোতাদিয়ায় উপজেলা স্বাস্থ্যা কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়।  

লায়লা ফেরদৌস হিমেল জানান, শামীমকে হাসপাতালে নেওয়ার পর ‘ওয়াশ’ করা হয়েছে বলে তার সঙ্গে থাকা শিক্ষকদের কাছ থেকে শুনেছেন তিনি।   

এদিকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে ওই ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সিরাজগঞ্জ পাবনা নগরবাড়ি মহাসড়কের বিসিক মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।

তাদের অবরোধের কারণে দুই দিকে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। গোলযোগ এড়াতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয় সেখানে।

ঘণ্টাখানেক পর শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নিয়ে আবার ক্যাম্পাসে ফিরে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

এদিকে অবরোধকারী শিক্ষার্থীদের একজন ব্লেড দিয়ে নিজের হাত কাটার চেষ্টা করেন বলে জানান আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি জাহিদুল ইসলাম সিরাজ। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষক লায়লা ফেরদৌস হিমেল বলেন, তিনিও সেটা শুনেছেন, তবে ঘটনার সময় তিনি সেখানে ছিলেন না।

২৬ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যায়ন বিভাগের ১৬ শিক্ষার্থীর মাথার চুল কেটে দেয়ার অভিযোগ উঠে ওই বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী প্রক্টর ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনের বিরুদ্ধে।  এর পরদিন নাজমুল হাসান তুহিন নামে এক ছাত্র ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

এ ঘটনার প্রতিবাদে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা বর্জন করে একাডেমিক এবং প্রশাসনিক ভবনে তাল ঝুলিয়ে দিয়ে বিক্ষোভ করেন। ওই দিন রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান, সহকারী প্রক্টর ও সিন্ডিকেট সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন ফারহানা বাতেন।

ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে সিন্ডিকেট সভা শেষে শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

কিন্তু স্থায়ী বহিষ্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলতেই থাকে। একপর্যায়ে শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন থেকে সরে যান শিক্ষার্থীরা।

গত ২২ অক্টোবর তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনকে স্থায়ীভাবে অপসারণের সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় শনিবার থেকে শিক্ষার্থীরা আবারও আন্দোলন শুরু করে।