জয়পুরহাটে হিমাগারের আলু তুলছে না ব্যবসায়ীরা

দাম কমে যাওয়ায় লোকসান এড়াতে হিমাগারে রাখা আলু তুলছেন না জয়পুরহাটের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।

মোমেন মুনি জয়পুরহাট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Oct 2021, 03:55 AM
Updated : 9 Oct 2021, 03:55 AM

কৃষক-ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, বর্তমান বাজারে ৬০ কেজির এক বস্তা আলুতে চার থেকে পাঁচশ টাকা লোকসান হচ্ছে। ফলে কমে গেছে এই পণ্যের বেচা-কেনা। তাই যারা হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করেছিল তারা ‍উত্তোলন করছে না। অথচ আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে এসব আলু হিমাগার থেকে তুলে নেওয়ার কথা।

এই অবস্থায় চরম বিপাকে পড়েছেন জেলার কৃষক, ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকরা।

কৃষক ও ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি হিমাগারে সংরক্ষিত আলুর বিশাল মজুদ নিয়ে লোকসানের দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে হিমাগার কর্তৃপক্ষেরও।

এই লোকসান থেকে বাঁচতে সংশ্লিষ্টরা সরকারের সহায়তাকারী উদ্যোগ কামনা করেছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক বাবলু কুমার সুত্রধর জানান, দেশে আলু উৎপাদনে শীর্ষ স্থানে থাকা জয়পুরহাটে এবার ৪০ হাজার ৩১৫ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদিত হয়েছে ৮ লাখ ৪৫ হাজার ২৯৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে জেলার ১৭ হিমাগারে সংরক্ষিত আলুর পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন।

“গেল বছর দাম বেশি পেয়ে গত এপ্রিল-মে মাসে আলু সংক্ষরণ মৌসুমে কৃষকের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করেন।”

জেলায় ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরা দেশি জাতের লাল ও সাদা পাকরী, রোমানা ও জাম অলুর পাশাপাশি উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের ডায়মন্ড, গ্যানোলা, মিউজিকা, রোজেটা, এস্টোরিকস, কার্ডিনাল জাতের আলু চাষ করেন এবং সেগুলো বিভিন্ন হিমাগারে সংরক্ষণ করেন বলে তিনি জানান।

আলু ব্যবসায়ী ও কৃষকরা জানান, ৬০ কেজির প্রতি বস্তা আলু ক্রয়, হিমাগার ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিলে দেশীয় জাতের আলু সংরক্ষণ বাবদ খরচ হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা; আর প্রতিবস্তা উফশী জাতের আলুতে বস্তা প্রতি খরচ পড়েছে এক হাজার ৫০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে প্রতি বস্তা দেশীয় জাতের আলু সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায় ও উফশী জাতের আলু সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কালাই উপজেলার মাদারপুর গ্রামের লোকমান হোসেন, বাদাউচ্চ গ্রামের মাজহারুল ইসলাম, মাদাই গ্রামের বেলাল হোসেনসহ অনেক আলু চাষি বাজার মূল্যের এমন তথ্য দিয়ে জানান, আলুর বাজার দর নিম্নমুখী হওয়ায় তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। হিমাগারে মজুদ করা প্রতি বস্তা আলুতে তাদের ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।

আলু ব্যবসায়ী কালাই উপজেলার মোলামগাড়িহাটের মজিবর রহমান মোহসিন, বাখরা গ্রামের মানিক হোসেন, ক্ষেতলাল উপজেলার বটতলী এলাকার মিজানুর রহমানসহ অনেক আলু ব্যবসায়ীরা বলেন, সংরক্ষণ মৌসূমে আলু ব্যবসায়ীদের অনেকে হিমাগার মালিকদের কাছে শতকরা ২০ থেকে ২৪ টাকা হারে সুদে ঋণ নিয়ে সেই টাকায় আলু কিনে হিমাগারে রাখেন। এখন আলুর বাজার পরে যাওয়ায় লোকসানে তাদের দিশেহারা অবস্থা, হিমাগার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করবেন কীভাবে, তা ভেবে কুল কিনারা করতে পারছেন না তারা।

গত বছর দাম বেশি হওয়ায় সরকার বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করলেও এবার লোকসান ঠেকাতে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই বলেও অভিযোগ ব্যবসায়ী ও কৃষকদের।

জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার আলু রপ্তানিকারক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সূচি এন্টারপ্রাইজ’-এর স্বত্ত্বাধিকারী মো. সুজাউল ইসলাম বলেন, “গত ৯ বছর যাবত আমি সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কুয়েত, দুবাই, নেপাল ও রাশিয়া আলু রপ্তানি করে আসছি। সম্প্রতি করোনার কারণে বিদেশি ব্যবসায়ী ও সরকার আলু নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।”

এ দিকে আলুর বাজারে চাহিদা না থাকায় বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ায় হিমাগারে মজুত বিপুল পরিমাণ আলু নিয়ে বিপাকে রয়েছেন হিমাগার মালিকরা।

কালাই উপজেলার সালামিন ফুডস লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রতন কুমার, মোলামগাড়িহাট নর্থপোল কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক মনোয়ার হোসেন, পুনট কোল্ড স্টোরেজ-এর ব্যবস্থাপক বিপ্লব কুমার ঘোষসহ হিমাগার কর্তৃপক্ষ ও হিমাগার সংশ্লিষ্টরা জানান, আলুর দাম না থাকায় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা হিমাগারে আলু নিতে আসছে না। ফলে এবার সংরক্ষণের অর্ধেকেরও বেশি আলু হিমাগারে মজুদ রয়েছে। মাত্র  ৪০ ভাগ আলু বিক্রি হয়েছে, ৬০ ভাগ মজুদ রয়েছে জেলার হিমাগারে। অথচ হিমাগার খালি করার সময়সীমা রয়েছে আগামী ১৫ নভেম্বর।

এ অবস্থায় হিমাগারে সংরক্ষণ করা আলু নিয়ে তারা চরম উৎকন্ঠায় রয়েছেন বলে জানান হিমাগার মালিক ও কর্মকর্তারা।

কোনো কোনো হিমাগারে সংরক্ষণ করা আলুর বিপরীতে ঋণও দেওয়া হয়েছে। বর্তমান বাজার অনুযায়ী আলু বিক্রি করে হিমাগারের ভাড়া আর ঋণের টাকা শোধ করতে না পারায় অধিকাংশ ব্যবসায়ী আলু নিতে দেরি করছেন বলেও হিমাগার মালিকদের ভাষ্য।

এ অবস্থায় আলুর বাজার দর ঠেকাতে সরকারের আশু পদক্ষেপ দাবি করেছেন ভূক্তভোগীরা। আলুর দামের মন্দাবস্থা কাটাতে সরকারি উদ্যোগে বিদেশে রপ্তানি করা ছাড়াও টিসিবি অথবা টিআর ও কাবিখা প্রকল্পে আলু সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন হিমাগার মালিকরা।

এ ব্যাপারে  জয়পুরহাট জেলা মার্কেটিং কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, গত বারে ত্রাণ হিসাবে করোনা ও রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারিভাবে বিপুল পরিমাণ আলু কেনায় কৃষকরা আলুতে লাভ করেছিলেন, এবারেও বিকল্প ব্যবস্থায় আলু কেনার কথা সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তরা ভাবছেন, যাতে কৃষকরা লাভবান হন।

জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বাবলু কুমার সুত্রধর বলেন, জেলায় লক্ষ্যমাত্রার অধিক পরিমাণ আলু চাষ হয়েছে। অধিকাংশ কৃষকরাই স্থানীয় হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণ করেছে। আলুতে যদি কৃষক দাম না পায় তাহলে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে এবং আগামী মৌসুমে আলু চাষ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

এ সত্বেও লোকসান হলেও জয়পুরহাটের কৃষকরা আলু আর ধান রোপন থেকে কখনও বিমুখ হবেন না; এবং এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “আলু আর ধান, জয়পুরহাটের কৃষি ক্ষেত্রের প্রাণ। জেলার অতীত রেকর্ড তাই বলে।”