সন্তানের অবহেলায় পড়ন্ত বয়সে অবলম্বন বৃদ্ধাশ্রম

মানিকগঞ্জের ঘিওরের আমেনা বেগমের স্বপ্ন ছিল শেষ বয়সে সন্তান আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো আনন্দে কাটিয়ে দেওয়া। কিন্তু সন্তানের অবহেলা মায়ের সে আশার স্বপ্ন নিভিয়েছে; স্বজনের যত্নের বদলে পেয়েছেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য।

আবুল হোসেন গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Oct 2021, 04:51 AM
Updated : 2 Oct 2021, 05:13 AM

শেষ পর্যন্ত ৬১ বছর বয়সী আমেনার ঠাঁই মিলেছে গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে।

সন্তানের সংসারের সুখ মেলেনি; এখন এই বৃদ্ধাশ্রমকেই জীবনের অবলম্বন করেছেন ‘কৃষ্ণা ব্যানার্জী’ থেকে হয়ে ওঠা আমেনা। এখানের নিঃসঙ্গ আরও অনেককে সঙ্গী করে বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চান তিনি।   

জীবনের শেষ ভাগে এসে এমন পরিণতির কথা জানাতে গিয়ে চোখ ভিজে ওঠে আমেনার; আঁচলে পানি মুছে আবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলতে শুরু করেন ফেলা আসা জীবনের গল্প। পুরানো স্মৃতি হাতড়ে সামনে আনেন তার কৃষ্ণা থেকে আমেনা হয়ে ওঠার কাহিনি।    

ঘিওর উপজেলার ত্বরা এলাকায় কৃষ্ণার বাবার ছিল বিঘায় বিঘায় সম্পত্তি। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট বোন হিসেবে এই ব্রাহ্মণ মেয়ের আদরের কমতি ছিল না তার। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কৃষ্ণার বয়স ছিল ১০ বছর। পাক হানাদার বাহিনী তাদের বাড়িতে হানা দিয়ে বাবা-মাকে ইঁদারায় (আন্দা কুয়ায়) ফেলে এবং চার ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। বড় ভাই চলে যান মুক্তিযুদ্ধে।

স্বজন হারিয়ে তখন তার জায়গা হয় হাফিজ উদ্দিন নামের এক কুর-আন হাফেজের ঘরে। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর বড় ভাইয়ের কাছ ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম বাড়িতে পালিত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ-ফেরত ভাই তাকে আর বাড়িতে ঠাঁই দেননি। এক সময় ভাইও নিখোঁজ হয়ে যান। আর ‘সম্পত্তির লোভে’ কাকারা জাত খোয়ানোর অপবাদ দিয়ে তাকে পরিবারে ঢুকতে দেননি।

এক সময় আমেনা ধর্মান্তরিত হন এবং তাকে ঢাকার একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করান হাফিজ উদ্দিন। পরে আমেনা ১৯৮১ সালে দাখিল ও পরে আলিম পাশ করেন। সে বছরেই বদিউল আলম নামে মসজিদের এক ইমামের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পাশাপাশি তিনি কুর-আনের হাফেজ হন।

পরপর তার দুই মেয়ের জন্ম হয়। কিন্তু সেই সংসারও ছিন্নভিন্ন হয় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুতে।

আমেনা বলেন, মৃত্যুশয্যায় স্বামী তার হাত ধরে লেখাপড়া চালিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। স্বামীর কথামতো তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে দীর্ঘদিন সরকারের উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন শেষে গত বছর অবসরে যান তিনি।

মাত্র ১০ বছর বয়স থেকে সংগ্রাম করে আসা এই ভাগ্যবিড়ম্বিত নারী নিজের উপার্জিত অর্থে দুই মেয়েকে মানুষ করেছেন। মেয়েদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বহুতল বাড়িও করেছেন ঢাকার কেরাণীগঞ্জে। সন্তানদের করেছেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত; বিয়েও দিয়েছেন।

কয়েক বছর আগে তার ছোট মেয়ের স্বামী মারা গেলে মেয়ে ও নাতনিদের তিনি তার বাসায় নিয়ে আসেন। নাতনিদের নিয়েই ভালোই কাটছিল অবসরের দিনগুলো। তাদের সঙ্গেই শেষ দিন পর্যন্ত কাটানোর ইচ্ছা ছিল।

আমেনার অভিযোগ, তার অর্থের জন্য মেয়েরা এক পর্যায়ে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে শুরু করেন। নিজের সঞ্চয়ের ৫৫ লাখ টাকা ছিল ব্যাংকে গচ্ছিত। তার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে এটিএম কার্ড ও পিন নম্বর নিয়ে কয়েক দফায় পুরো টাকায় উঠিয়ে নেন তার এক মেয়ে।

আমানে বলেন, আরেক মেয়ে প্রতিনিয়তই টাকার জন্য তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে থাকেন। মেয়ের এমন আচরণে দাগ কেটে যায় তার মনে। তার প্রতিটি কাজেই বাধা হয়ে দাঁড়ান এই মেয়ে।

দিনের পর দিন এই মেয়ের খারাপ আচরণের কারণে এক সময় আত্মহত্যারও সিদ্ধান্ত করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাতি-নাতনিদের স্নেহের টানে তা পারেননি। গত ১৪ মার্চ ভোরে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে  চলে আসেন গাজীপুরের বৃদ্ধাশ্রমে।

আমেনা বলেন, “অর্থের জন্য নিজের মায়ের সাথে এমন আচরণ কি ভোলা যায়? তাই তাদের সুখের কথা বিবেচনা করেই তাদের কাছ থেকে দূরে সরে এসেছি। অন্তত তারা যেন ভালো থাকে। মৃত্যু পর্যন্ত এমন আশীর্বাদ থাকবে তাদের জন্য।”

গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভালো আছেন বলে জানালেন আমেনা। এখানে সংসারের কোনো ঝামেলা নেই। ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া, গোসল, টিভি দেখে, অন্য নিবাসীদের সঙ্গে গল্প করে, লুডু খেলে, খবরের কাগজ পড়ে সময় কাটছে তার। তার জীবনের শেষ ইচ্ছা এখানেই যেন তার বাকি সময়টা কাটে।

গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের সহকারী ব্যবস্থাপক হাবিবা খন্দকার বেলী জানান, ১৯৮৭ সালে ঢাকার উত্তরার আজমপুরে ৮ কক্ষের এই পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। পরে ১৯৯৫ সালে গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া মনিপুরে বড় পরিসরে এটি স্থানান্তরিত হয়।  

এখানে নারী ও পুরুষ নিবাসীদের জন্য অলাদা বাসস্থান, চিকিৎসার জন্য মেডিকেল সেন্টার, চিত্তবিনোদনের জন্য টেলিভিশন, কেরাম, লুডু-দাবাসহ নানা সামগ্রী রয়েছে।

এখানে জমিতে ধানসহ বিভিন্ন ফসল ও পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে। রয়েছে একটি বেকারিও। এখানকার উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রী নিবাসীদের সরবরাহ করা হয়।

বর্তমানে এখানে ৭৬ জন পুরুষ ও ৫৭ জন নারী রয়েছেন বলে জানান বেলী।

বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল বলেন, যাদের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি এবং যারা চলাচলে সক্ষম তারা বিনামূল্যে এ কেন্দ্রের নিবাসী হওয়ার সুযোগ পান।

এখানে তাদের বিনামূল্যে খাবার ও কাপড়-চোপড় দেওয়া হয়। এখানে যার যার ধর্ম পালনের সুযোগ রয়েছে। কেউ চাইলে এখানেই নিজ নিজ ধর্মের রীতি অনুযায়ী সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়।