ছিটমহল বিলুপ্তির ছয় বছর: কেমন আছেন তারা?

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া অশীতিপর আব্দুস সালাম স্ত্রীকে হারিয়েছেন ১০ বছর আগেই। দেশভাগের পর ভারতের নাগরিক হয়েও ছিল না ভোটাধিকার, মেলেনি সেই দেশের ডাল-ভাত, শিক্ষা, চিকিৎসা কোনো কিছুই। পরিবার নিয়ে ভুগেছে দশকের পর দশক।

লালমনিরহাট প্রতিনিধিআনিছুর রহমান লাডলা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2021, 06:30 PM
Updated : 1 August 2021, 07:31 AM

কাগজে-কলমে ভারতীয় হলেও আদতে সীমান্তের কাঁটাতার থেকে তার অবস্থান ছিল অনেক দূরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। তখন ছিলেন ভারতের ভিতরকুটি-বশপচাই ছিটমহলের বাসিন্দা।

সেই অবরুদ্ধ জীবনের অবসান ঘটে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে। পহেলা অগাস্টের প্রথম প্রহরে বিনিময় হয় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল। এ বিনিময়ের পর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

তার ছয় বছর পূর্তির ঠিক আগে শনিবার বিকেলে লালমনিরহাট সদর উপজেলার বিলুপ্ত ভিতরকুটি-বশপচাই ছিটমহলে আব্দুস সালামের বাড়িতে তার সাথে কথা হয়।

স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, “কিচ্ছু পাই নাই তখন। চলাফেরা, হাট-বাজার করির পাই নাই। চিকিৎসা পাই নাই। তখন দোজখে আছনো (ছিলাম) হামরা (আমরা)’।

এসব কথা বলতে বলতে দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার।

কিছু সময় থেমে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা না হইলে ছিটমহলের জন্ম নেওয়া পাপেই হামরা মরি গেইনো হায়। উনি না হইলে ছিটমহল বিনিময় হইল না হয়। হামরা তার কথা কোনো দিন ভুলমো না।”

বর্তমান পরিস্থিতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন অনেক ভালো আছি। আমাদের এলাকায় এখন পাকা রাস্তা হয়েছে, বিদ্যুৎ এসেছে। বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়া যাচ্ছে।

শুধু আব্দুস সালাম নন। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর প্রায় সব বাসিন্দারই অবরুদ্ধ জীবনের যেমন আলাদা আলাদা কষ্টগাঁথা আছে। তেমনি ভারত-বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময়ের পর রয়েছে সন্তুষ্টি, প্রশান্তি।

স্থলসীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে বাংলাদেশের চার জেলার অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল মিশে যায় এ দেশের ভুখণ্ডে। অপরদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার এবং জলপাইগুড়ি জেলার অভ্যন্তরে থাকা ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল হয়ে যায় ভারতীয় ভুখণ্ড।

চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহলবাসীরা দুদেশেই নাগরিকত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগও পান। প্রতিবেশী দেশটির অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দাদের কেউ নাগরিকত্ব নিয়ে এদেশে না এলেও বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলগুলো থেকে হাজার খানেক মানুষ সেদেশে চলে যান।

বিলুপ্ত ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের মধ্যে লালমনিরহাট সদর ও হাতীবান্ধায় ছিল দুটি করে এবং পাটগ্রাম উপজেলার অভ্যন্তরে ছিল ৫৯টি। এর বাইরে কুড়িগ্রামে ১২, নীলফামারীতে চার এবং পঞ্চগড়ে ৩৬টি ভারতীয় ছিটমহল ছিল।

বিনিময় চুক্তি কার্যকরের পর লালমনিরহাটে পড়া ছিটমহলগুলোয় ব্যাপক উন্নয়ন শুরু হয়। এসব এলাকায় পাকা রাস্তা, বিদ্যুতের, সেচের জন্য সৌরবিদ্যুত চালিত পাম্পের ব্যবস্থা হয়েছে। অনেক ঘরে গেছে সৌরবিদ্যুৎ। ঘরে ঘরে বসানো হয় টয়লেট, নলকূপ। একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শহীদ মিনারও হয়েছে।

বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধীদের সরকারি ভাতার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। চাকরিতে বিশেষ কোটা চালু করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

হাতীবান্ধা উপজেলার উত্তর গোতামারী গ্রামের (বিলুপ্ত ছিটমহল) স্কুল শিক্ষক বকুল চন্দ্র রায়ের স্ত্রী শান্তনা রানী রায় বলেন, “আগে বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। এখন এসব সব সুবিধা পাচ্ছি, আমরা ভালো আছি।”

বৃদ্ধ মজিবর রহমান বলেন, “আগে কঠিন অবস্থায় ছিলাম আমরা। না যেতে পেরেছি ভারতে না পেয়েছি বাংলাদেশের কোনো সুবিধা। এখন অনেক সুখে আছি। ভোট দিতে পারছি, সুবিধা পাচ্ছি। আমরা এখন শান্তিতে আছি।”

গৃহবধূ জামিলা বেগম বলেন, “রাস্তাঘাটের সুবিধা হয়েছে, ল্যান্ট্রিন দিয়েছে, নলকূপ পেয়েছি। আমরা এখন সুখেই আছি।”

লেখাপড়ার সমস্যা নাথাক কথা উল্লেখ করে কলেজ শিক্ষার্থী আলামিন ইসলাম বলেন, “সরকারের কাছে দাবি জানাই, চাকরি ক্ষেত্রে ছিটমহলের জন্য আমাদের আলাদা কোটা দেওয়া হোক।”

প্রায় একই ধরণের নানা প্রাপ্তির কথা স্বীকার করেছেন পাটগ্রামের বাঁশকাটা, লতামারি, পানিশালাসহ একাধিক বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভিতরকুটি বশপঁচাই বিলুপ্ত ছিটমহলের হারুন অর রশিদ জানান, বিনিময়ের পর থেকে এ দেশের অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। জমিজমা কেনাবেচা করতে পারছেন।

“তবে রেকর্ডের সময় কিছু ভুলত্রুটি হয়েছে সেগুলো নিরাসন করা দরকার।”

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার উত্তর গোতামারী গ্রামের (বিলুপ্ত ছিটমহল) আজিজুল ইসলাম বলেন, গ্রামের ছোটছোট রাস্তাগুলো পাকা না করায় খুব কষ্টে চলাফেরা করতে হচ্ছে।

“আমরা গ্রামে একটা মাধ্যমিক স্কুল করেছি, সেখানে এলাকার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। স্কুলটি এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। সরকারের কাছে আমাদের জোর দাবি স্কুলটি যেন এমপিওভুক্ত করা হয়।”

পাটগ্রাম উপজেলা নিবাহী অফিসার সাইফুর রহমান জানান, ছিটমহল বিনিময় দিবস উপলক্ষে ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে বিলুপ্ত বাশকাটা ছিটমহলের বাসিন্দারা কেক কেটে, মোমবাতি প্রজ্বলন করবেন তারা।

রোববার সকালে জেলার বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে বলে জানিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা।