এখানে সাপের কামড়ের রোগীকে চিকিৎসা নিতে কয়েক ঘণ্টার সড়ক পাড়ি দিয়ে যেতে হয় বিভাগীয় শহর সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
বিষধর সাপ কামড়ালে দ্রুত অ্যান্টিভেনম নেওয়ার ব্যাপারে চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলেও বন ও চা বাগান অধ্যূষিত এ জেলায় সেই সুযোগ নেই।
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জনান, বাংলাদেশে ২৭টি বিষধর সাপসহ ৭৯ প্রজাতির সাপের সন্ধান পাওয়া গেছে; যেগুলোর বেশিভাগের অস্তিত্ব লাউয়াছড়া বনসহ মৌলভীবাজারে রয়েছে।
বছর দশেক আগের এক গবষেণায় ৫২ প্রজাতির সরিসৃপের অস্তিত্ব পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, এসব সাপের মধ্যে লাউয়াছড়া বনে অজগর, কিং কোবরা, দাঁড়াশ, আইড ক্যাট স্নেক, সবুজ বোড়া, লাউডগা, কালনাগিনী, দুধরাজ, ঢোঁড়া, হিমালয়ান ঢোঁড়াসহ ৩৯ প্রজাতির সাপের সন্ধান পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ শ্রীমঙ্গলের সহকারী বন সংরকক্ষ শ্যামল কুমার মিত্র বলেন, “এ এলাকায় কাউকে বিষাক্ত সাপে কামড় দিলে সিলেট পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে বাঁচানো সম্ভব না। মৌলভীবাজারে অ্যান্টিভেনম থাকা খুবই প্রয়োজন।
তিনি জানান, সম্প্রতি সাপে কাটা এক ব্যক্তি শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং সেখান থেকে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নেওয়া পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কিন্তু সিলেটে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
শ্রীমঙ্গলের জেরিন চা বাগানের ব্যবস্থাপক সেলিম রেজা চৌধুরী জানান, তার বাগানের এক শ্রমিককে বিষধর সাপেকাটার পর শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজার হাসপাতাল ঘুরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়। কিন্তু পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু হয়।
তিনি বলেন, “যদি মৌলভীবাজারে এর ব্যবস্থা থাকত তাহলে হয়ত তাকে বাঁচানো যেত।”
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক সজল দেব বলেন, গত বছর কুলাউড়ায় সাপের কামড়ে চা শ্রমিকসহ দুই নারী মারা যান। প্রায়ই সাপের কামড়ের শিকার হচ্ছে এ জেলার মানুষ।
তিনি জানান, গত ২৪ জুলাই শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের প্রফুল্ল দেবের আট বছর বয়সী ছেলে প্রীতম দেবকে বাড়ির পাশে ছড়ার পাড়ে সাপে কামড় দেয়। তাকে চিকিৎসার জন্য সিলেটে নেওয়া হয়।
১৯ জুলাই শ্রীমঙ্গলের জেরিন চা বাগান থেকে তিনটি জীবিত এবং দুটি মৃত সাপ উদ্ধার করা হয়; যার মধ্যে তিনটি বিষধর সাপ ছিল। এরই একটির কামড়ে ১৮ জুলাই জেরিন চা বাগানের শ্রমিক সুমন মিয়া মারা যান।
৫ জুলাই শ্রীমঙ্গল এম আর খান চা বাগানে স্বল্প বিষাক্ত এক সাপের কামড়ে আহত হন চা শ্রমিক অমল বাহাদুর নেপালীর ছেলে প্রবাসী নেপালী (২৭)। তাকে তিনদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়।
১৫ জুলাই জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার তিলকপুর গ্রামে এক মনিপুরী অধিবাসীর গোয়াল ঘর থকে ১৫টি ডিমসহ বিষধর গোখরো সাপ উদ্ধার করে শ্রীমঙ্গল বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন।
এছাড়াও চলতি বছরে আরও অসংখ্য সাপ উদ্ধার হয়েছে বলে জানান সজল।
সাপে কাটা চিকিৎসার ব্যবস্থা না হওয়ায় আক্ষেপ করে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সিতেশ রঞ্জন দেব বলেন, বহুদিন ধরে মৌলভীবাজারে সাপে কাটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করা হলেও ‘কোনো কাজ হয়নি’।
শুধু বন-জঙ্গলেই নয় ইঁদুর খেতে বাড়িঘরেও প্রচুর সাপ চলে আসে বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “আইসিইউ বেড থাকলে ভালো হয়। কারণ অ্যান্টিভেনম প্রদানের সময় বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় (অ্যানাফাইলেকটিক শক) রোগীর মৃত্যু হতে পারে।”
মৌলভীবাজারে সাম্প্রতিক সাপের উপদ্রবের ব্যাপারে অবগত থাকার কথা উল্লেখ করে জেলার সিভিল সার্জন ডা. জালাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, মৌলভীবাজারের জন্য সাপের অ্যান্টিভেনম বরাদ্দ হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের সাপের কামড়ের চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, সিভিল সার্জন এ চিকিৎসার নিদের্শনা দিয়েছেন জানিয়ে উপজেলা স্থাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা বলেছেন, এ চিকিৎসা দেওয়ায় তারা এখনও ‘প্রস্তুত নন’।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী জানান, তাদের হাতে এখনও অ্যান্টিভেনম এসে পৌঁছায়নি। তাছাড়া এটি দেওয়ার জন্য তারা এখনও প্রস্তুত না।
মৌলভীবাজারে সাপের কামড়ের অ্যান্টিভেনমের ব্যবস্থা রাখার দাবি জানিয়েছেন এ জেলার চা বাগানের বাসিন্দারা।