হাসেম ফুডসের আগুন: নাগরিক দলের তদন্ত শুরু

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসে আগুনে পুড়ে ৫২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত নাগরিক কমিটি তদন্ত শুরু করেছে।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2021, 12:23 PM
Updated : 17 July 2021, 12:23 PM

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জোর্তিময় বড়ুয়াকে আহ্বায়ক করে গঠিত দলটি শনিবার দুপুরে কারখানা পরিদর্শন করে।

জোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, “কারখানাটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আমরা নিচতলা থেকে ভবনের সব তালা ঘুরে দেখার চেষ্টা করেছি। আমরা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, চারতলায় এসি রুম ছিল। সেখানেই বেশি লোকের প্রাণহানি হয়েছে।

“আমরা শুনেছি চার তলার উৎপাদন ব্যবস্থাপক মাহবুব হোসেনও মারা গেছেন। আমরা তথ্য নিচ্ছি। আমরা অন্যান্য ডকুমেন্টও নেওয়ার চেষ্টা করব। সরকারের অন্য যেসব দপ্তর রয়েছে তাদের বক্তব্য এবং তাদের কাছ থেকে ডকুমেন্ট নেওয়ার চেষ্টা করব। তাদের কে কী কী দায়িত্ব পালন করেছিলেন তা দেখব। তদন্ত শেষে একটি প্রতিবেদন জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হবে।”

তদন্ত দলে শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, শ্রমিকনেতা, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রকৌশলী, স্থপতিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিনিধি রয়েছেন।

কমিটি আগামী ৩০ কার্য দিবসের মধ্যে ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করবে বলে তিনি জানান।

কমিটির সদস্য জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “বাংলাদেশেবিভিন্ন ধরনের কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও কর্মস্থলে অগ্নিকাণ্ডে অকাল মৃত্যু ও বিভিন্ন হতাহতের ঘটনা নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশে যেসব কারণে অকালে শিশু, নারী পুরুষ, কিশোর মারা যাচ্ছে সেসব কারণ দূর খুবই সম্ভব।

“কিন্তু আমরা দেখছি, কারখানায় আগুন লেগে মানুষ মারা যাচ্ছে। রাসায়নিক গুদামে লেগে মানুষ মারা যাচ্ছে। এই অকাল মৃত্যুতে সরকার থেকে তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু ওই কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় না। দায়ী ব্যক্তিরাও শনাক্ত হয় না এবং যে প্রতিকার করা দরকার তাও হয় না। ফলে এই ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে। এত বছর পরও রানা প্লাজা, তাজরীনের ঘটনায় বিচার হয়নি।”

তিনি বলেন, “কারখানাগুলোয় যে ধরনের বিধিমালা থাকার তা থাকে না। সে কারণে আমরা দায়িত্ববোধ করেছি, সংবিধানেও আছে। হাসেম ফুডস শুধু না, পুরো বাংলাদেশের কারখানাগুলো যেভাবে চলে, শ্রমিকরা যে কর্ম পরিবেশে কাজ করে, সরকারি প্রতিষ্ঠান যাদের দায়িত্ব আছে, তারা যদি কাজ না করে তাহলে এই ধরনের অকাল মৃত্যু বারবার ঘটতে থাকবে না। সেজন্য বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে নাগকিরদের পক্ষ থেকে এই কমিটি করা হয়েছে।

“এই তদন্ত দল অনুসন্ধান করবে, এই ঘটনায় মালিকপক্ষের দায় কতটা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায় কতটা এবং আগুন লাগার আগে কারখানার কর্মপরিবেশ কেমন ছিল, যার কারণে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটল। শিশুশ্রমিক ছিল কি না, যদি শিশুশ্রমিক থেকে থাকে, তাহলে কোন আইনে তারা সেখানে কাজ করেছে, শ্রমিক যারা কাজ করত তাদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ছিল কি না, তাদের মজুরি ঠিকমত দেওয়া হত কি না, তাদের কর্মঘণ্টা কত ছিল, তাদের ওভার টাইম পরিশোধ করা হয়েছিল কি না, কারখানাটি দেখাশোনার জন্য শ্রম পরিদর্শকের দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি তার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেছিলেন কি না, ভবন নকশা ও ভবনটি কারখানা করার উপযোগী কি না—এসব বিষয়ে আমাদের তদন্ত দল কাজ করবে এবং সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।”

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “আমরা জানি কারখানার চারপাশ খোলা রাখতে হয়। কিন্তু আমরা এখানে এসে দেখেছি কারখানার দু পাশ খোলা রাখা হয়েছে। যদি কারখানার চারদিক খোলা থাকত তাহলে শ্রমিকরা যেখানে মারা গেছেন, সেখান থেকে তারা বের হওয়ার রাস্তা পেতেন। বিষয়গুলো আমরা অনুসন্ধান করব। আশা করছি ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করব। কেন আগুন লাগাল, আগুন তো লাগতেই পারে, কিন্তু সেই আগুন লাগার জন্য অনুকূল পরিবেশ কিভাবে তৈরি হল, কারখানায় অগ্নিপ্রতিরোধে কী ধরনের ব্যবস্থা ছিল, জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি কেন থাকল না, অগ্নিনির্বাপণে কেন শ্রমিক ও ব্যবস্থাপকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হল না—এসব নানা বিষয় খুঁজবে তদন্ত দল।

“আমাদের তদন্তের সুপারিশমালা শুধু এই কারখানার জন্য নয়, দেশের সব শিল্প খাতের জন্য। এই খাতকে আরও নিরাপদ করার জন্য। এই খাতে যারা কাজ করেন তাদের জীবন আরও নিরাপদ এবং শিল্প খাত যেন আরও টেকসই হয় তা বিবেচনায় রেখে সুপারিশমালা দেব। আশা করব, দাবি করব, সরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, মালিকপক্ষ ও সরকারি সংস্থা সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবে যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে।”

বাংলাদেশ শ্রম ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি গোলাম মুর্শেদ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার লিমা, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি শবনম হাফিজ, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম সবুজ কারখানা পরিদর্শনের সময় ছিলেন।

গত ৮ জুলাই হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুনে ৫২ জনের প্রাণহানি হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে কারখানার মালিক আবুল হাশেম, তার চার ছেলেসহ আটজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে।

পুলিশ তাদের চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বুধবার তাদের আদালতে হাজির করা হলে আবুল হাশেমসহ ছয়জনকে কারাগারে পাঠানো হয়। হাশেমের দুই ছেলের জামিন মঞ্জুর করে আদালত।

ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।