সীমান্তে ঘরে ঘরে জ্বর, ‘লকডাউনের ভয়ে’ কোভিড পরীক্ষায় অনীহা

যশোরের ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা অঞ্চলে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়লেও গ্রামবাসী রোগ আড়ালের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আসাদুজ্জামান আসাদ, বেনাপোল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 July 2021, 02:26 PM
Updated : 12 July 2021, 03:06 PM

একই সাথে সংক্রমণ রোধে শহর এলাকায় প্রশাসনের তৎপরতা দেখা গেলেও গ্রামাঞ্চলে মানুষ কোনো বিধিনিষেধই মানছে না।

শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইউসুফ আলী বলেন, “কোভিড পজিটিভ হলে বাড়ি লকডাউন হবে, এই ভয়ে গ্রামের মানুষের পর্যাপ্ত করোনা টেস্ট হচ্ছে না।”

শার্শা উপজেলার নমুনা পরীক্ষা ও ফলাফল

 

তারিখ          নমুনা সংখ্যা           শনাক্ত                     শনাক্তের হার

 

২ জুন          ৫৭ জন                ২০ জন                    ৩৫     শতাংশ

৪ জুন          ১৫ জন                ০৫ জন                    ৩৩    শতাংশ

৫ জুন          ৬৪ জন                 ২৯ জন                   ৪৫     শতাংশ

৬ জুন          ৪১ জন                 ১৮ জন                    ৪৪     শতাংশ

৭ জুন          ৫৭ জন                ১৮ জন                     ৩২     শতাংশ

৯ জুন          ৩৫ জন                ১৩ জন                     ৩৭     শতাংশ

  ১২ জুন         ৫৭ জন                ১৪ জন                      ২৪.৫৬   শতাংশ

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনম সেন্টারের আরটিপিসিআর পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ‘শার্শার প্রায় সব গ্রামের বাসিন্দারই সংক্রমণ ধরা পড়েছে’।  

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার জাহিদুল ইসলাম বলেন, সোমবার পর্যন্ত উপজেলায় কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ২১ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৮০৭ জন। বর্তমানে আক্রান্ত আছেন ২০০ জন।

এ রোগ শনাক্ত হয়ে মারা গেছে নয় জন। তবে সরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা কম থাকলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম ডাক্তাররা বলছেন, করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধশতাধিক।

এ উপজেলার বেনাপোল, নাভারন, বাগআচড়া এবং শার্শা সদরে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি থাকলেও গ্রামের হাট-বাজার অরক্ষিত রয়েছে।

বসতপুর, জামতলা, সামটা, গোগা, বালুন্ডা, বারোপোতা, ডিহি, নিজামপুর, শাড়াতলা, কাশিপুর, লক্ষণপুর, উলাশি, বাহাদুরপুর, শাখারিপোতা বাজারে প্রশাসনের লোকজন উপস্থিতি দেখলেই দোকান বন্ধ হয়ে যায়। তারা চলে গেলেই বাজার ফের জমজমাট হয়ে ওঠে।

সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার বড় মার্কেট, শপিংমল বন্ধ রয়েছে। গলির মার্কেটগুলোয় অর্ধেক সাটার খোলা রেখে বেচাকেনা চলছে। প্রাইভেটকার, ভ্যান, ইজিবাইক, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলছে।

গ্রামের পাড়া মহল্লায় দোকানের সামনে-পেছনে বেঞ্চ পেতে বসে আড্ডা চলছে। গ্রামের বাজারে দোকানগুলো অর্ধেক দুয়ার খোলা রেখেছে।

বসতপুর গ্রামের মেম্বর আলি আহম্মদ বলেন, "বসতপুর, ছোট কলোনী, বড় কলোনী গ্রামের ৭০ ভাগ মানুষ করোনা উপসর্গের জ্বর সর্দি কাশি গলাব্যাথা শ্বাসকষ্টে ভুগছে।

“এই এলাকায় করোনা উপসর্গে ১৩ জন মরে গেছে, এরমধ্যি আপন দুই ভাইও রয়েছে। তারপরও মানুষ কচ্ছে 'কুথায় করোনা'।কারণে-অকারণে বাজারে এসে বসে থাকছে।"

উপজেলার মহিশাকুড়া ও বাগাডাঙা গ্রামের মেম্বার নাসির উদ্দিন বলেন, এই দুই গ্রামের ৫০ ভাগ বাড়িতে জ্বর সর্দি কাশি গলাব্যাথা শ্বাসকষ্টের রোগী রয়েছে। উপসর্গ নিয়ে ৪ জন মারা গেছে। অনেকে দিনের পর দিন ভুগছে, অনেকে সেরেও উঠেছে।

টেংরা গ্রামের মেম্বর মোজাম গাজি বলেন, “প্রথম প্রথম কোলি মানুষ কথা শুনতো। এখন পুলিশ বিজিবি আসে তারা কিছু কচ্ছে না, আমরা তো পাবলিক আমরা কোলি শুনবে কেন?

"প্রশাসনের লোকজন আসলি সবাই দুকান বন্ধ রাখে। তারা চলে গেলি আবার সবাই খুলে বেচাকিনা করে।"

উত্তর শার্শার লক্ষনপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, উপসর্গে অন্তত ২৫ জন মারা গেছে। সপ্তাহ খানেক আগে এই এলাকার প্রতিটি ঘরে করোনা উপসর্গের রোগী ছিল। এখন ৩০ ভাগ বাড়িতে রোগী আছে।

বাগআচড়া ইউপি চেয়ারম্যান ইলিয়াছ কবির বকুল বলেন, করোনা উপসর্গে এই ইউনিয়নে অন্তত ৩৬ জন মারা গেছে। তারপরও মানুষ সচেতন না।

পশুহাটের কারণে প্রতিদিন বাইরের ব্যাপরিরা আসায় করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।

পাশের উপজেলা কলারোয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, গ্রামের মানুষ করোনা উপসর্গকে সাধারণ জ্বর হিসেবে দেখছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

“যখন শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে তখনই দৌড়াদৌড়ি শুরু করছে। এরমধ্যে অনেকেরই ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে।”

আক্রান্তদের কোয়াক ডাক্তারের কাছে না নিয়ে হাসপাতালে নিলে মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকত বলেন তিনি।

যশোর সদর হাসপাতালের ডা. আক্তারুজ্জামান বলেন, গ্রামের মানুষ একেবারেই শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আসছে। করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা এসব মানুষের অন্য রোগ থাকায় মৃত্যু হচ্ছে।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনোম সেন্টারের সহকারী পরিচালক অধ্যাপক ড. ইকবাল কবীর জাহিদ জানান, যশোরে করোনার ডেল্টা ধরন ৪২ শতাংশ এবং গামা ধরন ৩০ শতাংশ ছড়িয়ে পড়েছে। যা এখন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে।

ডেল্টা ধরণে আক্রান্ত একজন রোগী ৬ জনকে আক্রান্ত করছে। তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা ৮৩ শতাংশ, আর গামা ধরনে হৃদরোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা ৬০ শতাংশ এ তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, এটাকে রোধ করতে দ্রুত টিকাদান এবং মানুষের শরীরে ইমিউনিটি বাড়াতে হবে। না পারলে সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতি আসতে পারে।

শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর আলিফ রেজা বলেন, “আমরা সার্বক্ষণিক বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজ করে যাচ্ছি। তবে মানুষ সচেতন না।

"আমরা যতক্ষণ থাকছি ততক্ষণ সবাই আইন মানছে। চলে আসলেই যা তাই।"