রূপগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন বলছে, স্বজনদের বক্তব্যের ভিত্তিতে ৪৫ জন নিখোঁজ শ্রমিকের তালিকা করেছে তারা।
তবে ১৮ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে জ্বলতে থাকা ছয়তলা ওই কারখানা ভবনে কারও বেঁচে থাকার খুব বেশি আশা দেখছে না ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন বলেন, “ছয় তলা ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলা এখনও জ্বলছে, আমরা ল্যাডার দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু ওই অংশে প্লাস্টিক ও কেমিক্যাল সামগ্র থাকায় নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।”
তিনি বলেন, আগুনের প্রচণ্ড তাপে ভবনের একটি অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। উপর থেকে জানালার থাই অ্যালুমিনিয়ামের স্ট্রাকচারসহ জ্বলন্ত বিভিন্ন অংশ খুলে পড়ছে। কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে কারখানার উপরের অংশ থেকে।
শুক্রবার ভোরের দিকে আগুন প্রায় নিয়ন্ত্রণে এসে গেলেও সকালে পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় নতুন করে আগুন বেড়ে যায়। কারখানায় আটকা পড়া কর্মীদের সন্ধান না পেয়ে ততক্ষণে বাইরে জড়ো হওয়া স্বজনরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
এক পর্যায়ে তারা কারখানা কম্পাউন্ডের বাইরের অংশের আরেকটি অক্ষত ভবনে ঢিল ছুড়তে শুরু করেন এবং বাইরে থাকা সাতটি মোটর সাইকেল ও তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করেন।
পুলিশ তাদের থামাতে গেলে শুরু হয় সংঘর্ষ। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দিয়ে পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আনে।
জ্বলতে থাকা কারখানা ভবনের ফটকের বাইরে উদ্বিগ্ন স্বজনদের অনেককে আহাজারি করতে দেখা যায়।
ইয়াসিন রিপন নামে এক শ্রমিকের মা নাজমা বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, “কোনো বিচার নাই, কোনো বিচার নাই গো। আমি কারো কাছে হাত পাতি নাই, ছেলেরে এসএসসি পাস করাইছি। আমার বাবার কোনো খবর নাই গো।”
সজীব গ্রুপের হাসেম ফুডস কারখানায় আগুন লাগার সময় কতজন ছিল, সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি।
রূপগঞ্জের ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মিন্টু বৈদ্য জানান, স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে তারা ৩৮ জন নিখোঁজ শ্রমিকের তালিকা করেছেন। আরও অনেকে আসছেন তাদের স্বজনদের খোঁজে।
আর রূপগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের প্রকল্প বাস্তবায়ন সহকারী আশরাফ সিদ্দিকী বলেছেন, বেলা ১২টা পর্যন্ত ৪৫ নাম নিখোঁজ শ্রমিকের নাম তারা পেয়েছেন স্বজনদের কাছ থেকে। তবে এ সংখ্যা বাড়তে পারে।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন বলেন, “আগুন লাগার পর অনেকে লাফিয়ে পড়ে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। অন্তত ২৫ জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে কতজন বেঁচে বের হতে পেরেছেন আমরা জানতে পারিনি।
“ভেতরে যারা আটকা ছিলেন, তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা এখনি বলা যাচ্ছে না। তবে খুব বেশি আশা আর দেখছি না। হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে।”
বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টাার দিকে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পর দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে নিচতলা, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। পরে উপরের ফ্লোরেও আগুন ছড়িয়ে যায়।
বৃহস্পতিবার রাতে মৃত দুই নারীর পরিচয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম। তারা হলেন- সিলেট জেলার যতি সরকারের স্ত্রী স্বপ্না রানী (৩৪) এবং রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল নতুন বাজার এলাকার হারুন মিয়ার স্ত্রী মিনা আক্তার (৩৩)।
এছাড়া রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার পর আরেকজনের মৃত্যু হয়। তার নাম মোরসালিন (২৮) বলে জানিয়েছেন মেডিকেল পুলিশ ফাড়ির পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া।
মোরসালিনের বাড়ি দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার উত্তর সুবেদপুর গ্রামে। বাবার নাম আনিসুর রহমান। এক ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি বড় ছিলেন।
এছাড়া নাহিদ, মঞ্জুরুল ইসলাম, মহসীন হোসেন, আবু বকর সিদ্দিক, আমেনা বেগম ও ফাতেমা আক্তার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।
পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নারায়ণগঞ্জ থেকে ছয়জনকে আনা হয়, তাদের মধ্যে তিনজনের ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট হওয়ায় বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে।”
আহত আবু বকর জানান, কারখানায় আগুন লাগার পর বাঁচার জন্য ভবন থেকে লাফ দিয়েছিলেন তিনি, তখনই আহত হন।
আগুনে কারখানাটির বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল, উৎপাদিত পণ্য নষ্ট হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরুপণ করা যায়নি। আগুন কীভাবে লাগল- সে বিষয়েও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা কিছু বলতে পারেননি।
কারখানার উপমহাব্যবস্থাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, “গ্যাস লাইন লিকেজ কিংবা বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে।”
এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে বলে ডিসি মোস্তাইন বিল্লাহ জানান।