‘১৫ বছর’ হারুনের সংসার ছোট্ট ছাপড়ায়

ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায় ইছামতি নদীর তীরে ছোট্ট ছাপড়ায় পরিবার নিয়ে ১৫ বছর ধরে বসবাস করছেন নিঃসম্বল হারুন।

আসাদুজ্জামান সুমন কেরানীগঞ্জ-দোহার-নবাবগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2021, 04:14 PM
Updated : 7 July 2021, 04:42 AM

বাহ্রা ইউনিয়নের দক্ষিণ চৌকিঘাটা বলমান্তা গ্রামে ইছামতী নদীর তীরে ছোট ছাপড়ায় থাকেন মো. হারুন (৪৬), স্ত্রী আছমা খাতুন (৪৩) ও মেয়ে সম্পা (১২)।

বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর ভিটে বিক্রির সব টাকা হারুনের ‘বড় ভাই নিয়ে চলে গেছেন’। হতদরিদ্র হারুন মানুষের কাছে চেয়ে, ভিক্ষা করে দিনাতিপাত করেন।

প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরসহ বিভিন্ন সময় সাহায্য সহযোগিতা চেয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বলেও কোনো কাজ হয়নি বলে হারুনের অভিযোগ।

সরেজমিনে দক্ষিণ চৌকিঘাটা বলমান্তা গ্রামে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মন্টু মিয়া (৫৮) ও স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. আলাউদ্দিনসহ (৬০) কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভিক্ষাবৃত্তি ও মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে জীবনধারণ করেন হারুন। তার ‘কিছুটা মানসিক সমস্যা’ রয়েছে। তার স্ত্রীরও একই অবস্থা। তাদের মেয়েটি দিন দিন বড় হচ্ছে। দীর্ঘ প্রায় পনেরো বছরের বেশি সময় ধরে তারা ওই ঝোপে ভয়ের মধ্যে থেকে খুব দুঃখকষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

“তারা যদি সরকারিভাবে কোনো সাহায্য সহযোগিতা বা নিরাপদ বাসস্থান পায় তাহলে আমরা স্থানীয়রা খুবই খুশি হব।”

এলাকার ফার্ণিচার মিস্ত্রী মোকন্দ্র মনিরিশ বলেন, হারুন ভাই অসহায় ও নিতান্তই ভালো মানুষ। তার মানসিক সমস্যা থাকায় আশপাশের লোকজন তাকে হারুন পাগলা নামে এক নামে চেনে। অনেকেই স্বেচ্ছায় তাকে সাহায্য সহযোগিতা করেন।

“গতকালও একজন মহিলা চাল ডালসহ বেশকিছু প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য কিনে তাদের বাড়ি এসে দিয়ে গেছেন দেখেছি। এছাড়া কারো কাছে সে কিছু চাইলে সকলেই তাকে সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন।”

“উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে উপকৃত হয় এরকম কিছু যদি আপনারা করতে পারেন দয়া করে করেন।

হারুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাবা-মা মরে যাওয়ার পর আমাগো আগলা খাঁন হাঁটির গ্রামের বাড়ির পৈত্রিক সম্পত্তি আমার একমাত্র বড় ভাই বারেক (৪৯) ও আমি মিলে বেইচা দেই। পরে আমার ভাই প্রতারণা করে সম্পত্তি বেচার সব টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।”

সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পর কোমরগঞ্জ হাঁটের সরকারি জায়গায় বাঁশের খুঁটি দিয়ে তাঁবু ও ব্যানার লাগিয়ে কোনোরকমে একটি ঘর তৈরি করে প্রায় দশ বছর কাটাইছি।

“সেখানে আমার একমাত্র শিশু ছেলেকে শিয়ালে কামড়ালে সে মইরা যায়। এর লিগাই তো আমি খালি কই আমার ছেলেরে শিয়ালে খাইছে।”

পরে হারুনকে সেখান থেকে তখনকার চেয়ারম্যান উঠিয়ে দেন বলে জানান হারুন।

এরপর আগলা দক্ষিণ চৌকিঘাটা গ্রামের মাসুদ খান মজলিস তার চাচাত ভাই ইসতিয়াক আহমেদের সঙ্গে কথা বলে তার নদীর পাড়ে জঙ্গল মতো জায়গায় তাদের থাকতে দেয়।

তিনি বলেন, “এখানে ছাপড়া ঘর তুলে ১৫ বছর ধরে থাকতাছি। আমি ভিক্ষা করে ও মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে অতি কষ্টে সংসার চালাই। এ পর্যন্ত আমি ও আমার পরিবার কোনো ধরনের সরকারি সহযোগিতা পাই নাই।

“সরকারি সহযোগিতা পাওয়ার জন্য আমি বহুবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় মেম্বার সিকিম আলীর কাছে গিয়া সাহায্য চাইছি; কিন্তু তারা আমার লিগা কিছুই করে নাই।”

হারুন বলেন, “আর এখন সাংবাদিকরা আমার কথা জাইনা আমার কাছে আইতাছে। এ কারণে সিকিম আলী মেম্বার আমারে মারতে আসে। আমাকে কয়- তোরে মাইরা ফালামু।”

ঘরে থেকে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি নিয়ে এসে দেখিয়ে হারুন বলেন, “আমি এতিম। আমার কেউ নাই। আমার জায়গা নাই, ঘর নাই কিছু নাই। এর লিগাই তো অন্যের জায়গায় এই ঝোপের মধ্যে সবসময় ভয়ের মধ্যে থাকি। বউ ও মেয়েকে নিয়া আমি নিরাপদে থাকবার চাই।

“আমি ও আমার স্ত্রী সব সময় নৌকা মার্কায় ভোট দেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপহার হিসেবে তো অনেক গরীব মানুষকে জায়গা ও ঘর দিছে। আমিও তো গরীর। আমারও তো কিছু নাই। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি জায়গা ও একটি ঘর চাই।”

হারুন সম্পর্কে জানতে চাইলে সিকিম আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হারুনকে আমি বহুবার ঘর ও ভাতার জন্য আইডি কার্ড দিয়ে একটা আবেদন করতে বলেছি। এমনকি আবেদন লিখার জন্য একটি দোকানও দেখিয়ে দিয়েছি। তারপর না পারলে বলেছি আমার কাছে আসতে; কিন্তু সে কিছুই করেননি। এছাড়াও হারুনের মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে চিয়েছি। তাতেও তিনি রাজি হননি।

“হারুন পাগলা এরকম করলে আমি কী করব আপনারাই বলেন। তারপরও দেখি ওর জন্য কিছু করতে পারি কিনা। ওর জন্য কিছু করতে পারলে আমারও তো ভালো লাগবে, তাই না?”

হারুনের বিষয়ে কথা বলতে বাহ্রা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাফিল উদ্দিন মিয়ার মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

নবাবগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, “বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ভাতা পাওয়ার জন্য তারা আমাদের কাছে আবেদন করলে তাদের কাগজপত্র যাচাইবাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এইচ এম সালাউদ্দিন মনজু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হারুনের বিষয়ে আমার জানা ছিল না। আপনার কাছ থেকে জানলাম। পরিবারটি যদি ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বা ইউপি সদস্যের মাধ্যমে বা যেকোনো মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আমার কাছে জমা দেয় তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবশ্যই নেওয়া হবে।”