নদীভাঙনের শিকার রুমি বেগম এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলেন। তিনি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব গ্রামের বাসিন্দা।
গত বছর বন্যায় সারডোবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে আড়াই শতাধিক পরিবার ভিটে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। এ বছরও বাঁধের অংশ-বিশেষ ভেঙে বাঁধ সংলগ্ন ২০টি পরিবার ভিটেমাটি হারায়।
তাদের অধিকাংশেই ঠাঁই হয়েছে বাঁধের রাস্তায়। এখানে তাজুল-রুমি দম্পতি বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় বিক্ষিপ্ত পড়ে থাকা আসবাবপত্র, ঘরের খুঁটি, খড়ি জড়ো করে আনছিলেন। কাঁঠাল, সুপারিসহ নানা জাদের গাছ ভেসে গেছে নদীতে। সরেজমিন ধরলা পারের সারডোবে গিয়ে চোখে পড়ে তাদের সীমাহীন এসব দৃশ্য।
গত শনিবার বৃদ্ধা আবিয়ার স্বপ্ন ভিটেমাটি সব গ্রাস করেছে ধরলা নদী।
তার প্রতিবেশীরা জানান, চোখের সামনে আবিয়ার ভিটা ‘গিলে খেয়েছে ধরলা’। থাকার ঘরের চাল বাঁচাতে পারলেও যত্নে বড় করা গাছ, আসবাবপত্র ভেসে গেছে পানিতে। তাই আবেগ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যায় তারজন্য।
বৃদ্ধা আবিয়া বলেন,“ধল্লা এক আইতে হামার সউগ শ্যাষ কল্লে। জমি-জিরাত হামার কিচ্চু নাই। গড়োত নিয়া যায় চালটা থুছি। মানষে খাবার দিলে খাই, না দিলে উপ্যাস থাকি।এলা হামরা কোনটে থাকমো-এই চিন্তায় নিদ ধরেনা।”
বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে ধরলার ভাঙনে কুড়িগ্রামের কয়েকটি স্থানে শতাধিক পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। ভেঙে গেছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কিছু অংশ।
ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে বাঁধ, স্কুলসহ বহু স্থাপনা। ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো রাস্তা এবং বাঁধের উপর আশ্রয় নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নিচে বাস করছে।
উজানের ঢল আর টানা বর্ষণে ধরলার পানি বেড়ে ভাঙনের তাণ্ডব শুরু হয়েছে মেকলি, ধনিরাম, গোড়ক মন্ডল, চর কৃষ্ণপুর, পাঁচগাছি, সারডোবসহ বিভিন্ন স্থানে।
ভিটেমাটি, ফসলি জমি, গাছপালা নিমিষেই চলে যাচ্ছে নদীগর্ভে। ভাঙনের তীব্রতার মুখে ঘরবাড়ি সরানোর ফুরসৎ মিলছে না। অন্যের সাহায্যের উপর জীবন চলছে বাঁধের রাস্তায় থাকা পরিবারগুলোর।
দিনমজুর বাবলু মিয়া জানান, ১৫/২০ দিন ধরে হাতে কাজ নেই। ধার-দেনা বাড়ন্ত। পকেটে মাত্র ১০০ টাকা। এ অবস্থায় ভিটে থেকে ঘর সরিয়ে এখন একবেলা খেলে অন্যবেলা অভুক্ত থাকতে হচ্ছে।
ওমেদ আলী স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজে ঘর বাড়ি সরিয়েছেন। এখন রাস্তার উপর আছেন।
শাহ আলম বলেন, “এলা বাড়ি ঠিক করি না ধার শোধ করি। ধল্লা হামাক মারি ফেলাইলে।’
তার প্রতিবেশী বাবুল মিয়া চালা তোলায় ব্যস্ত। মাত্র কয়েক গজ দূরেই গর্জন করছে ধরলার স্রোত।
স্থানীয় বাসিন্দা ওসমান মিয়া বলছেন, সারডোবের বাঁধ রক্ষায় চলমান পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প শুরু করতে ঠিকাদারের গড়িমসির কারণে দুর্ভোগ নেমে এসেছে নদী পারের মানুষের।
ওসমান বলেন, “আইজকা দুই বস্তা ফেলায়, কাইল পাঁচ বস্তা ফেলায়। এই করতে হামার ঘরবাড়ি ভাসি গেইল।”
তবে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম দাবি, ধরলার ভাঙন এখনও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভাঙন প্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
এছাড়া ধরলায় চলমান ৫৯৫ কোটি টাকার বৃহৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভাঙন রোধ হবে বলছেন তিনি।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিলুফা ইয়াছমিন জানান, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে সহায়তা দেওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
“তালিকা এখনও হাতে আসেনি। তালিকা পেলে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে।”