ছবির মধ্যে বাবাকে খুঁজে বেড়ায় সামি-রায়না

পাঁচ বছর আগের এই দিনে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত হন পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল করিম। তার দুই সন্তান সাজিদুল করিম সামি আর কামরুন্নাহার রায়না ছবির মধ্যেই এখন তাদের বাবাকে খুঁজে বেড়ায়।

হাসিবুর রহমান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2021, 09:08 AM
Updated : 1 July 2021, 09:46 AM

পাঁচ বছর আগে নজিরবিহীন ওই হামলার মাসখানেক পর জন্ম হয় রবিউলের দ্বিতীয় সন্তান রায়নার। আর তার বড় ভাই সামির চলছে ১১ বছর। সামি এখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।

রবিউলের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীর দিন বৃহস্পতিবার কথা হয় তার স্ত্রী উম্মে সালমার (৩৮) সঙ্গে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি  বলেন, “সামি বাবার অনেক আদরের ছিল। আমি সামিকে যদি শাসন করতে চাইতাম রবিউল সব সময়ই বাধা দিত। সে সামিকে স্নেহে আগলে রাখত সব সময়।”

“আর রায়না তো বাবার স্পর্শও পায়নি। তবু আমার মনে হয় বাবা জিনিসটা কী তা সে অনুভব করতে পারে। ছবির অ্যালবাম থেকে ইউনিফর্ম পরা বাবার সব ছবি খুঁজে দিতে পারে সে। ছবি দেখে দুই ভাইবোনই বাবাকে সালাম দেয়। আর কখনও বা এসে আমাকেই বাবা বলে ডাকে।”

বাবাকে খুঁজে বেড়ানোর সেই দৃশ্য সালমার বেদনার আরও বাড়িয়ে তোলে।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে গলা কেটে হত্যা করে জঙ্গিরা। হামলার সময় জঙ্গিদের ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম এবং বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন খান।

রবিউলপত্নী সালমা বলেন, “বেঁচে থাকতে রবিউল স্বপ্ন দেখত শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাহীন শিশু ও কিশোরদের জন্য একটি বিশেষায়িত বিদ্যালয়, একটি বৃদ্ধাশ্রম এবং একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার। স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও বাকি দুইটা কাজ করে যেতে পারেনি রবিউল। তাছাড়া স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেও এখনও তা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়নি।

“অবহেলিত শিশুদের নিয়ে রবিউল সব সময় কাজ করার চেষ্টা করত। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য। সেই ভালোবাসা থেকে বাড়ির কাছে মানিকগঞ্জের বাসাই গ্রামে ২০১১ সালে রবিউল প্রতিষ্ঠা করে ‘বিকনিং লাইট অরগানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি নামে একটি বিশেষায়িত বিদ্যালয়।”

বর্তমানে বিদ্যালয়টি রবিউলের ছোট ভাই শামসুজ্জামান শামস দেখাশোনা করেন বলে জানান সালমা।

তিনি বলেন, “রবিউল যখন বাড়ি আসত তখন এলাকার বৃদ্ধ নারী-পুরুষ তার কাছে এসে জড়ো হত। একেকজন তার কাছে নিজেদের পারিবারিক কলহের কথা জানাত। যা তাকে অনেক কষ্ট দিত। সেখান থেকেই তার চিন্তা ছিল স্কুলের পাশাপাশি একটি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করার।”

ঢাকার ধামরাই উপজেলার দেপাশা গ্রামের মোহাম্মদ শাহজাহানের মেয়ে সালমার সঙ্গে ২০০৮ সালে রবিউলের বিয়ে হয়। সালমা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন।

আর রবিউল ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। বাংলায় স্নাতকোত্তর করে বিসিএস দিয়ে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন তিনি।

রবিউলের মৃত্যুর পর পরিবারের অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে তার স্ত্রী সালমাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাকরির সুযোগ করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক কার্যালয়ের শিক্ষা শাখায় অ্যাডহক ভিত্তিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে তিনি যোগ দেন ২০১৭ সালে। এজন্য তিনি বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। বর্তমানে চাকরির সুবিধার্থে বাবার বাড়ি ধামরাই উপজেলার দেপাশা গ্রামে থাকেন সালমা।

রবিউলের ছোট ভাই শামসুজ্জামান শামস (৩৫) রবিউলের প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া বিশেষায়িত স্কুলটি দেখভাল করেন। তিনিও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ (৩৫তম ব্যাচ) থেকে স্নাতকোত্তর করেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “স্কুলটিআমরা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল আবাসিক স্কুলে রূপ দেওয়ার কিন্তু এখন পর্যন্ত তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। স্কুলে বর্তমানে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ৫০ জন শিশু-কিশোর পড়াশোনা করে। আমরা তাদের প্রাথমিক শিক্ষাটা এখানে দিয়ে থাকি।”

তিনি বলেন, তিনজন শিক্ষক, একজন ফিজিওথেরাপিস্ট, একজন কর্মকর্তা আর একজন কর্মচারী নিয়ে স্কুলটি চলছে। ভাইয়ের বন্ধুদের পাশাপাশি গ্রামের মানুষের অনুদানে ব্যয় বহন করা হয়। প্রতি মাসে প্রায় ৮০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। ভ্যানে করে প্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুলে নিয়ে আসা এবং বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করা এবং স্কুলের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে সম্মানী দেওয়া বাবদ।

বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংগঠন যদি স্কুলটিকে আবাসিক করার কাজে এগিয়ে আসেন তাহলে ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ হবে বলে জানান তিনি।

পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় রবিউল করিমের কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচমেট মানিকগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর সাহা, ভাই শামসুজ্জামান শামসসহ বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। পরে রবিউল করিম প্রতিষ্ঠিত স্কুলে মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

ঢাকার কূটনীতিকপাড়া গুলশানের ওই হামলায় ২২ জনকে হত্যার দায়ে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর নব্য জেএমবির সাত সদস্যের ফাঁসির রায় দেয় আদালত। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান জনাকীর্ণ আদালতে আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

প্রায় এক বছর আগে মামলার পেপারবুক প্রস্তুত হলেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। এর জন্য করোনাভাইরাস মহামারীকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা।