পাবনায় তাঁতিদের শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানিতে ‘বঞ্চনা’

করোনাভাইরাস মহামারীতে তাঁতিদের জন্য সরকারের দেওয়া শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠেছে একটি ‘চক্রের’ বিরুদ্ধে।

সৈকত আফরোজ আসাদ পাবনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2021, 12:45 PM
Updated : 24 June 2021, 12:45 PM

সম্প্রতি পাবনার গয়েশপুরে এমন একটি ‘চক্রের’ বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় তাঁতিরা।

সরকার বিভিন্ন সময় প্রণোদনা, ঋণ সহায়তা ও শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুবিধা দিলেও তাঁতিদের ‘সরলতা’ ও ‘অজ্ঞতার’ সুযোগ নিয়ে কিছু লোক তাদের বঞ্চিত করছে বলে তাঁতিদের অভিযোগ।

সরকারের শুল্কমুক্ত সুবিধা এভাবে ‘হরিলুট’ হওয়ায় তাঁত বোর্ড ইতিমধ্যে এই সুবিধার প্রকল্প প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে; এবং সরাসরি তাঁতিদের কাছে সরকারি সহায়তা দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় কাজ করভে বলে জানান বোর্ড সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড ও স্থানীয় তাঁতিরা জানান, ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার সুতা, সোডিয়াম সালফাইডসহ বিভিন্ন কাঁচামাল শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির অনুমতি পায় গয়েশপুর ২ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি। প্রান্তিক তাঁতিদের নামে এসব কাঁচামাল আমদানি হলেও তারা এই বিষয়ে কিছু জানতে পারেননি।

তাঁতিরা জানান, চারটি শর্তে তাঁতি সমিতিকে শুল্কমুক্ত আমদানির সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান শর্ত হলো শুল্কমুক্ত এসব কাঁচামাল সমিতির তাঁতে ব্যবহার করতে হবে; কোথাও বিক্রি বা হাতবদল করা যাবে না।

কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি দালাল চক্র গয়েশপুর ২ নম্বর প্রাথমিক তাঁত সমিতির সভাপতি নূর ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাকিমকে সঙ্গে নিয়ে এসব কাঁচামাল আমদানি করে তা অবৈধভাবে বিক্রি করে দিয়েছে। ওই সমিতির ১৩০ জন প্রান্তিক তাঁতির কেউ তা জানেন না।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড থেকে জানা যায়, দেশের ৫১টি তাঁতি সমিতির নামে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার কাঁচামাল এলসির মাধ্যমে আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়। প্রায় ৪৫ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি করা হয় পাবনা জেলার পাঁচটি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির নামে।

তবে পাবনার প্রান্তিক তাঁতিরা এর কোনো সুবিধা পাননি বলে অভিযোগ করছেন।

গয়েশপুর ২ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতির সদস্য আনছার আলীর অভিযোগ, “আমাদের সমিতির ১৩০ জন তাঁতির ১২৯০টি তাঁতের বিপরীতে প্রায় ৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকার শুল্কমুক্ত সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করা হয়েছে। অথচ আমরা এর কিছুই জানতে পারিনি। সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক সাঁথিয়ার এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে এগুলো বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সরকারের শুল্কমুক্ত কাঁচামালের সুবিধার কিছুই আমরা পাইনি।”

তিনি আরও বলেন, “কিছুদিন আগে আমরা বিষয়টি সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকের কাছে জানতে চাইলে তারা ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে প্রান্তিক তাঁতিদের মারধর করিয়েছেন।”

এই চক্রটি করোনাকালীন সরকারের প্রণোদনার টাকাও আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ করে আনছার আলী বলেন, “প্রতিকার দাবিতে আমরা তাঁত বোর্ডে লিখিত অভিযোগের পাশাপাশি মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছি।”

পাবনা তাঁত বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত লিয়াজোঁ অফিসার জাকির হোসেন বলেন, “সরকার প্রান্তিক তাঁতিদের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিলেও তাঁতিদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে একটি চক্র আমদানি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে প্রান্তিক তাঁতিরা সুবিধা পাচ্ছেন না।”

গয়েশপুর ২ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁত সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাকিম অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবী করেছেন।

তবে উত্তোলিত শুল্কমুক্ত কাঁচামাল কী করেছেন জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাবনায় শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করেছে গয়েশপুর ২ নম্বর ওয়ার্ড, গয়েশপুর ৩ নম্বর প্রাথমিক তাঁতি সমিতি, আতাইকুলা ৬ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি, দোগাছি ৩ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি এবং একদন্ত ইউনিয়ন ৩ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি।

এই পাঁচটি সমিটির মধ্যে তিনটির তাঁতিরা আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাঁচামালের কিছুই পাননি।

এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকার কাঁচামাল আমদানি করেছে গয়েশপুর ৩ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি। কাঁচামাল না দিয়ে সমিতি থেকে তাঁতিদের প্রত্যেককে এক হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সদস্যরা।

এই ব্যাপারে সমিতিটির সভাপতি আয়ুব হোসেন বলেন, “শুল্ক ছাড়া কাঁচামাল এলসির মাধ্যমে আমদানির সময় এবং অর্থ কোনোটাই নেই প্রান্তিক তাঁতিদের। সাঁথিয়ার একজন ব্যবসায়ী আমাকে এলসির মাধ্যমে আমদানির কথা বলেন। তাঁতিদের লাভের বিষয়টি চিন্তা করেই আমি তার কথায় রাজি হয়ে যাই। সেই ব্যবসায়ী আমদানির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন; লভ্যাংশ হিসেবে ছয় লাখ টাকা দেন। সে টাকা আমি সমিতির ৫৫৮ জন সদস্যের প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করোনাকালীন সহায়তা হিসেবে দিয়েছি।”

তবে ওই আমদানিকারক ব্যবসায়ীর নাম বলতে রাজি হননি তিনি।

আতাইকুলা ৬ নম্বর ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতির কয়েকজন জানান, সমিতির নামে ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার তাঁতের কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে। সমিতির ১৭২ জন সদস্যের মধ্যে ৭০০ টাকা করে লভ্যাংশ হিসেবে টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।

শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা নিয়ে তাঁতিদের বঞ্চিত করায় পাবনায় ভুক্তভোগী তাঁতিরা তাঁত বোর্ডে অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের জেনারেল ম্যানেজার কামনাশিষ দাস বলেন, “তাঁতিদের জন্য সরকারের শুল্কমুক্ত সুবিধা এভাবে হরিলুট হওয়ায় তাঁত বোর্ড ইতিমধ্যে শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে।”

সরাসরি তাঁতিদের কাছে সরকারি সহায়তা দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে বলেও জানান তিনি।