‘সর্বাত্মক লকডাউনে’ রাজশাহী নগরী

ভারতে উদ্ভূত করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের স্থানীয় সংক্রমণে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ১০ দিন আগেই রাজশাহীসহ সাতটি জেলা অবরুদ্ধ করার সুপারিশ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি।

রাজশাহী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2021, 05:56 PM
Updated : 10 June 2021, 07:41 PM

এর একদিন বাদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও একই মত প্রকাশ করে বলেছিলেন, এসব জেলায় সর্বাত্মক লকডাউন জারি করা না হলে সঙ্কট আরও বাড়বে।

তারপরও প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ ছিল না।

এর মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে কোভিড-১৯ রোগীদের যখন মেঝেতে রাখতে হচ্ছিল; যখন রাজশাহী এক দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যায় দেশের অন্য যে কোনো জেলাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তখন রাজশাহীতে সর্বাত্মক লকডাউনের আদলে কঠোর বিধি-নিষেধের ঘোষণা এল।

বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার হুমায়ুন কবীর সিটি করপোরেশন এলাকায় ১১ জুন বিকাল ৫টা থেকে ১৭ জুন রাত ১২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা দেন।

তার আগে রাতে রাজশাহী সার্কিট হাউজে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জরুরি বৈঠক হয়।

সেখানে জেলায় পরীক্ষার তুলনায় কোভিড শনাক্তের হার ও মৃত্যুর হার বিশ্লেষণ করে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত আসে বলে বিভাগীয় কমিশনার হুমায়ুন কবীর জানান।

এই ঘোষণার পরপরই শুক্রবার মধ্যরাত থেকে রাজশাহীর সঙ্গে সারা দেশের যাত্রীবাহী সব ট্রেন চলাচল এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দেওয়ার পর গত এপ্রিলে সারা দেশে বিধিনিষেধ আরোপ হলেও তা অনেকাংশে এখন শিথিল। তবে রাজশাহীতে কঠোর বিধিনিষেধই ফিরিয়ে আনা হল, যাকে সর্বাত্মক লকডাউন বলা হচ্ছে। 

বিভাগীয় কমিশনার হুমায়ুন কবির বলেন, “লকডাউনের সময় সব দোকানপাট ও যান চলাচল বন্ধ থাকবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁ থেকে কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে পারবে না। রাজশাহী থেকেও কোনো যানবাহন জেলার বাইরে যাবে না।”

তবে রোগী ও অন্য জরুরি সেবাদানকারীর ক্ষেত্রে এ বিধি-নিষেধ খাটবে না বলে জানান তিনি।

বৈঠকের পর রাজশাহী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিধি-নিষেধগুলো তুলে ধরে বলা হয়, এগুলো না মানলে কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

যে সব ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ

>> সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শপিং মল, মার্কেট, দোকান, রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকবে।

>> বাস-ট্রেনসহ কোনো ধরনের যানবাহন রাজশাহী নগরীতে ঢুকতে পারবে না। রাজশাহী নগরী থেকে কোনো যানবাহন বেরও হতে পারবে না।

>> জনসমাগম হয় এমন বিয়ে, জন্মদিন, পার্টিসহ সামাজিক কোনো অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় সভা করা যাবে না।

>> সব পর্যটন স্থান, বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার বন্ধ থাকবে।

তবে ওষুধের দোকান, কাঁচাবাজার, চিকিৎসা সেবা ও মৃতদেহ সৎকারে যুক্ত ব্যক্তিরা এই বিধি-নিষেধের আওতার বাইরে থাকবে। অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি সেবার গাড়ি এবং আম পরিবহনে যুক্ত বাহনের উপরও নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।

এখন আমের মৌসুম বলে রাজশাহী থেকে সারাদেশেই আম পরিবহন হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা রাজশাহীতে যাওয়ায় সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছে।

বিভাগীয় কমিশনার বলেন, “আমের বাজারগুলো বড় পরিসরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাজার পরিচালনা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এক বছর পূরণ হওয়ার আগে পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকায় ৫ এপ্রিল সরকার সারাদেশে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে।

তাতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি দেখা দিলেও বিপরীত চিত্র দেখা যায় ভারত সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে। পরে দেখা যায়, ভারতে উদ্ভূত করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টটি বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি রাজশাহীসহ সাতটি জেলায় কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের সুপারিশ করে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে রোগী নিয়ে তার স্বজনরা।

এই সাতটির মধ্যে তখন শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়ই অবরুদ্ধ করা হয়েছিল।

পরদিন মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ওই জেলাগুলোতে দ্রুত লকডাউন দেওয়া দরকার।

সেদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘পরিস্থিতি বুঝে’ প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেবে।

তারপর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড ইউনিটে আরও একটি ওয়ার্ড চালু করার পরও রোগীদের মেঝেতে ঠাঁই নিতে হয়।

প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে রাজশাহীতে দিনে শনাক্ত রোগীর হার (নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায়) ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছিল।

বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে দেখা যায়, একক জেলা হিসেবে রাজশাহীতে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বাধিক ৩৫৩ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে।

রামেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক সাইফুল ফেরদৌস জানান, গত আটদিনে (১ জুন সকাল ৬টা থেকে ৯ জুন সকাল ৬টা পর্যন্ত) এ হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে মারা গেছেন ৮০ জন।