মহামারী ও দুর্যোগের মধ্যে নোয়াখালীর ইউপি নির্বাচন, পেছানোর আবেদন

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে নোয়াখালীতে ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে; যা পেছানোর আবেদন করেছেন কয়েকজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী।

নোয়াখালী প্রতিনিধিআবু নাছের মঞ্জু, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2021, 06:08 AM
Updated : 9 June 2021, 06:08 AM

আগামী ২১ জুন উপকূলীয় দুই উপজেলা হাতিয়া ও সূবর্ণচরের ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

ইউনিয়নগুলো হলো হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, জাহাজমারা, সোনাদিয়া, চর ইশ্বর, চরকিং, তমরুদ্দি ও বুড়ির চর এবং সুবর্ণচরের চরবাটা, চরক্লার্ক, চরওয়াপদা, চর আমানউল্যাহ, পূর্বচরবাটা ও মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন।

নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা ইয়াসের কারণে এলাকার যোগাযোগসহ সার্বিক প্রতিকূল অবস্থার কথা বলেছেন। অপরদিকে স্বাস্থ্য বিভাগ ভোটকে কেন্দ্র করে প্রচারে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির শঙ্কা করছে।

হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমরান হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, জাহাজমারা, সোনাদিয়া, চর ইশ্বর, চরকিং, তমরুদ্দি ও বুড়ির চর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়।

“বেড়িবাঁধ নেই এমন অনেক এলাকায় এখনও জোয়ারের সময় পথঘাট পানির নিচে তলিয়ে যায়।”

ইউএনও ইমরান হোসেন বলেন, “এলাকার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে আমাদেরকে যে নির্দেশনা দেওয়া হবে আমরা তা বাস্তবায়ন করব।”

নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন বলেন, তার ইউনিয়নের চারপাশে কোনো বেড়িবাঁধ না থাকায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারের তোড়ে পথঘাট চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

“এই অবস্থায় নির্বাচন হলে ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে পারবে না। তাছাড়া যোগযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঠিকভাবে কাজ করতে পারবেন না।”

“একজন প্রার্থী হিসেবে আমি এই নির্বাচন পেছানোর জোর দাবি জানাচ্ছি,” বলেন তিনি।

সোনাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ইয়াছিন আরাফাত বলেন, “হাতিয়ার প্রত্যেকটা ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ ছিড়ে বানভাসী মানুষ পানিতে ভাসছে। লোনা পানিতে দুর্বিষহ অবস্থা। মানুষের কাজ নেই, খাবার নেই, গরু-মহিষের চারণ ভূমি পর্যন্ত ডুবে আছে। এ অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে ভাবতে পারছি না। আগে মানুষের জীবন-জীবিকা। এরপর নির্বাচনের কথা ভাবা দরকার। আমরা এই নির্বাচন স্থগিত করার জন্য দাবি জানিয়েছি।”

সোনাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, “আমার এলাকায় বেশিরভাগ সড়ক ইয়াসের প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট উচ্চতায় জোয়ারের পানিতে বিধ্বস্ত হয়েছে। এখনও অনেক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রার্থী এবং ভোটাদের মধ্যে নির্বাচনের কোনো প্রস্তুতি নেই।”

বৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় প্রার্থীরা অনেক এলাকায় প্রচারণা চালাতে পারছেন না বলে জানান তিনি।

এই সময়ে নির্বাচন হলে অনেক ভোটার ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে না এবং এমনকি প্রশাসনের পক্ষেও নির্বাচনে যথাযথভাবে তদারকি করা সম্ভব হবে না বলে তিনি মনে করেন।

“তাই আমরা একাধিক প্রার্থী এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন স্থগিত করে শুষ্ক মৌসুমে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে লিখিত দাবি জানিয়েছি।”

চর ঈশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হালিম আজাদ বলেন, “পূর্ণিমা ও অমবস্যার জোয়ারে আমার এলাকার মানুষ যখন দিশেহারা তখন ভোট করার মতো অবস্থা প্রার্থী এবং ভোটার কারো মধ্যেই নেই। আমরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে জানিয়েছি। আশা করছি তারা বাস্তবসম্মত একটা সিদ্ধান্ত নেবেন।”

তমরদ্দিন ইউনিয়নের তমরদ্দি গ্রামের বাসিন্দা মাহতাব উদ্দিন রতন বলেন, “হাতিয়ার মানুষ এখন নির্বাচন নিয়ে ভাবছে না। ভাবছে জোয়ারের পানি থেকে কিভাবে নিজেদের রক্ষা করবে তা নিয়ে।”

সুশাসনের জন্যে প্রচারাভিযান জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল বলেন, “করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত মানুষের কথা চিন্তা না করে ঠিক এই সময়ে নির্বাচন দিতে হবে—কিসের এত বাধ্যবাধকতা আমি জানি না। স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচন তো সীমনা বিরোধসহ মামলার কারণে বছরের পর বছর ঝুলে আছে। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে একটা পথ তো বের করা যেত।

“আগে মানুষের নিরাপত্তা। এরপর নির্বাচন হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় নয় কি? আমরা আশা করব নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে একটা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেবে।”

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৩৯৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৯৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এনিয়ে জেলায় মোট শনাক্ত হয়েছে ৯ হাজার ১৫১ জন। এর মধ্যে হাতিয়া উপজেলায় ১৭১ জন ও সুবর্ণচর উপজেলায় ৪১৫ জন। জেলায় মোট মৃতের সংখ্যা ১২৪।

জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ৫ জুন থেকে ১১ জুন পর্যন্ত নোয়াখালী পৌরসভা এবং জেলা সদরের ছয় ইউনিয়নে বিশেষ লকডাউন ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন।

সিভিল সার্জন বলেন, যেকোনো সমাগমেই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। হাতিয়া ও সুবর্ণচর উপজেলায় ইউনিয়ন নির্বাচনের বিষয়ে করোনা প্রতিরোধ কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। সামনে আরও আলোচনা হবে।

“এটি একটি জাতীয় বিষয় বিধায় এ বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে সেটাই চূড়ান্ত।”

সূবর্ণচর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শায়লা সুলতানা ঝুমা বলেন, “এর আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে প্রচুর মানুষের শোডউন হয়। এ ধরনের শোডাউন বেশি হলে করোনা সংক্রমণ বাড়ার মারাত্মক ঝুঁকি থাকে। এখন তো করোনা পরিস্থিতির অবস্থা সারা দেশেই খারাপ। তাছাড়া আমাদের এখানে বর্তমানে ডায়রিয়া পরিস্থিতিও খুবই খারাপ।”

জেলা জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা মো. রবিউল আলম বলেন, “নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে আমাদের নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা সে মোতাবেক কাজ করছি। নির্বাচন পেছানোর বিষয়ে কয়েকজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর লিখিত আবেদন পেয়েছি। তাদের আবেদনের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।”

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান বলেন, “নির্বানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে নেই। তবে হাতিয়ার ইয়াস পরবর্তী অবস্থা এবং জেলার সার্বিক করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষকে অবহিত করছি।”