বাগেরহাটে করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকলেও পরীক্ষায় অনীহা এখনও

বাগেরহাটে করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকলেও এখনও অনেকের মধ্যেই পরীক্ষায় অনীহা রয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

বাগেরহাট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 June 2021, 05:17 AM
Updated : 8 June 2021, 05:17 AM

মহামারীর এক বছরে চিকিৎসা দিতে গিয়ে এ বিষয়ে অভিজ্ঞতার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন তারা।

জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিকিৎসা কর্মকর্তা সুব্রত দাস বলেন, ২০২০ সালের এপ্রিলে এ জেলায় প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়।

তিনি বলেন, “এই রোগের যেহেতু প্রতিষেধক নেই, তাই আমরা প্রথমে ভীত হয়ে পড়ি। কার শরীরে এই ভাইরাস আছে তা বোঝার উপায় ছিল না। তবু স্বাস্থ্যবিধি মেনে নানা ধরনের রোগী দেখতে থাকি।

“আমার কাছে আসা এই রোগীদের মধ্যে অনেকের মধ্যে উপসর্গ দেখতে পাই। তাদের  পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে বলা হলে তারা উল্টে বলেন, ‘তেমন কিছু নয়। এটা সিজনাল ফ্লু! একটু ওষুধেই ঠিক হয়ে যাবে।’ নমুনা দিতে তাদের দারুণ অনীহা। শিক্ষিত, অশিক্ষিত সব ধরনের মানুষের মধ্যে উপসর্গ গোপণের চেষ্টা লক্ষ করছি এক বছর ধরে।”

উপসর্গ দেখা দিলেই পরীক্ষার আহ্বান জানান এই চিকিৎসক।

আরেক সম্মুখ সারির যোদ্ধা বাগেরহাট সদর হাসপাতালের অর্থপেডিক বিভাগের কনস্যালট্যান্ট এসএম শাহনেওয়াজ।

তিনি বলেন, “শুরু থেকেই চিকিৎসক হিসেবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিলাম। শুরুতে দেশে মাস্ক, পিপিই কিছুই ছিল না। আমরা সবাই অনিরাপদ হয়ে পড়ি। চিকিৎসকরা অনিরাপদ থাকলে আক্রান্ত রোগীদের সেবা কিভাবে হবে? কর্মীদের সুরক্ষার চিন্তায় আমরা কয়েকজন মিলে মাস্ক ও পিপিই তৈরির উদ্যোগ নিই। মাস্ক ও পিপিই তৈরির সরঞ্জাম কিনে কয়েক দিনের মধ্যে তা তৈরি করি। সেসব হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সরবরাহ করি।

“ওই সময় একদিনও ভয়ে ঘরে বসে থাকিনি। রোগীদের সেবা দিয়েছি। প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে অনেকের শরীরে উপসর্গ দেখতে পেয়েছি। সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা পরীক্ষার কথা বললে তারা এড়িয়ে চলতেন। তাদের মধ্যে একটাই ভয়, যদি এই রোগ তার হয়েছে বলে প্রতিবেশীরা জানতে পারে তাহলে তাকে একঘরে হতে হবে। এই ভয়ে তারা পরীক্ষা করাতে নারাজ।”

তিনি বলেন, “ভয় দুর করতে, বেঁচে থাকার জন্য পরীক্ষা কতটা জরুরি তা বুঝিয়েও লাভ হয়নি। এক বছরের বেশি সময় ধরে রোগটি মানুষের শরীরে ছড়ালেও সাধারণ মানুষের মধ্যে অসচেতনতা এখনও বিদ্যমান। বিনা চিকিৎসায় নিজে মররে, আপনজনকে মারবে—তারা তা বুঝতে পারছে না।”

উপসর্গ গোপন করে অনেকে নিজে নিজে ওষুধ কিনে খেত বলে জানান বাগেরহাট সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের কনস্যালট্যান্ট সাঈদ আহমেদ।

তিনি বলেন, শুরুতে রোগীরা ভয়ে হাসপাতালে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি হলেই তারা ধারণা করত তাদের এই রোগ হয়েছে। তারা উপসর্গ গোপন করে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে সেবন করত।

“পরে পরিস্থিতি স্বভাবিক হলে রোগীর ভিড় বাড়তে শুরু করে হাসপাতালে। তবে তারা জ্বর-সর্দি হলে তা বলতে চাইত না। গোপন করত। রোগীকে দেখে বুঝতাম। তাদের বলতাম নমুনা দিয়ে পরীক্ষা করাতে। পরীক্ষায় পজিটিভ হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজের সুরক্ষা ও পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন। কোনো কোনো রোগী পরামর্শ শুনেছেন। তবে না শোনার সংখ্যাই বেশি ছিল।”

তিনি বলেন, “আমাদের অসচেতনতার কারণে প্রতিনিয়ত সংক্রমণ বাড়ছে। যেহেতু এই রোগের প্রতিষেধক নেই, তাই উপসর্গ দেখা দিলে পরীক্ষা করতে হবে। পজিটিভ হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তা নাহলে দিন দিন সংক্রমণের হার বাড়বে।”

বাগেরহাটে রোগটির প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে জানিয়েছেন জেলার সিভিল সার্জন কে এম হুমায়ুন কবির।

তিনি বলেন, এক বছরে এ জেলায় এক হাজার আট শতাধিক মানুষের শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। মারা গেছে ৪৭ জন। এর মধ্যে দ্বিতীয় ঢেউয়ে গত ৮ মার্চ থেকে অল্প পরিমাণ সংক্রমণ ধরা পড়ে। কিন্তু ২৬ মে থেকে জেলার মোংলা উপজেলায় বাড়তে থাকে। মার্চ থেকে ৭ জুন পর্যন্ত এ জেলায় আট শতাধিক রোগী শনাক্ত হয়েছে।

“সচেতন-অসচেতন লোকজন রোগ গোপন করে রেখে ইচ্ছামত ঘোরাফেরা করেছে। এতে সংক্রমণ বেড়েছে। সহসা কেউ নমুনা পরীক্ষায় রাজি হয় না।”

উপসর্গ দেখা দিলেই পরীক্ষা করানোর আহ্বান জানিয়েছেন এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।