দূষণ বাড়ছে সুন্দরবনের

মানুষের ‘নিয়ন্ত্রণহীন আচরণে’ সুন্দরবনের দূষণ দিন দিন বাড়ছে উল্লেখ করে এর রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা।

শুভ্র শচীন খুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2021, 04:15 AM
Updated : 5 June 2021, 04:15 AM

বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনের দূষণে উদ্বেগ ফুঠে ওঠে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের কণ্ঠে।

‘প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ৫ জুন শনিবার বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।

গবেষকরা বলছেন, বন সংলগ্ন এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপন, বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচল, পাচারের উদ্দেশ্যে বনের মধ্য বন্যপ্রাণী হত্যা, বিষ দিয়ে মাছ শিকার এবং নিয়ন্ত্রণহীন পর্যটনের কারণে ঘটছে দূষণ। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বনের গাছপালা, অন্য বন ও জলজ প্রাণীর ওপর।

এছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রভাব, সুন্দরী ও গেওয়াগাছের আগামরা রোগও সুন্দরবনের ক্ষতির কারণ।

সুন্দরবন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় বনের পানি ও মাটিতে লবণাক্ততা বেড়েছে। বেড়েছে নদীভাঙন ও পলি পড়ার হার। তার ওপর মানুষের অবিবেচকসুলভ কর্মকাণ্ডে সুন্দরবনে দূষণ আরও বেড়েছে।

সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করলেও সেই এলাকার মধ্যে অর্ধশতাধিক ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, খাদ্য বিভাগের বিশাল খাদ্য গুদাম, সিমেন্ট কারখানা, এলপি গ্যাস প্লান্ট, অয়েল রিফাইনারি, বিটুমিন, সি ফুড প্রসেসিং ফ্যাক্টরিসহ বহু কারখানা রয়েছে।

এসব শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পশুর নদে, যা বনের মাটি ও নদীতে মিশছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের এক গবেষণা প্রতিবেদনের বরাতে ওই ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ২০১০ সালে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদের প্রতি লিটার পানিতে তেলের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮ মিলিগ্রাম। আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮-তে। অথচ এর স্বাভাবিক মাত্রা ১০ মিলিগ্রাম।

(ফাইল ছবি)

“সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদের পানি ও মাটিতে দূষণ বেড়েছে। সে কারণে অনেক স্থানে আগের মতো গাছের চারা গজাচ্ছে না।”

তিনি বলেন, পানিতে তেলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলজ প্রাণী। যেসব রুটে নৌযান চলাচল করে, ওই রুটগুলোর বনের পাশে এখন আর তেমন হরিণ, বানরসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী দেখা যায় না।

প্রতিবছর সুন্দরবন ভ্রমণে যাচ্ছেন অসংখ্য পর্যটক।

শুধু ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক লাখ ৭৩ হাজার পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন বলে সুন্দরবন বিভাগের তথ্য থেকে জানা গেছে। 

সচেতনতার অভাবে অনেক পর্যটক চিপসের প্যাকেট, পলিথিন, পানি ও কোমল পানীয়ের বোতল, খাবারের প্যাকেট, উচ্ছিষ্ট অংশ, ওয়ান টাইম প্লেট ও গ্লাস ফেলছেন বনের মধ্যে মাটি ও নদীতে।

উচ্চ শব্দে গান বাজানো, বনের মধ্যে বুঝে কিংবা না বুঝে হৈচৈ করা সবকিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বনের ওপর।

সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে দীর্ঘদিন ধরে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে কয়েকটি চক্র। এর ফলে বিভিন্ন মাছের পোনা, কাঁকড়া, সাপসহ জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। পাচারের উদ্দেশ্যে বনের মধ্য বিষ দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে বাঘ ও কুমির। এতে দূষণ বাড়ছে বনে।

তিনি বলেন, সুন্দরবনে পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়ছে। বনে লোনা পানির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর বসতি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ধরনের উদ্ভিদও উচ্চ লবণাক্ততা সহ্য করতে না পেরে মারা যাচ্ছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. নাজমুস সাদাত বলেন, সুন্দরবনের দূষণরোধে বনবিভাগকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) খুলনার সমন্বয়কারী এম বাবুল হাওলাদার বলেন, দূষণের কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। ইসিএ এলাকায় স্থাপিত শিল্প কারখানা ও বনের মধ্যদিয়ে জলযান চলার কারণে সুন্দরবনে দূষণ বেড়েছে।

সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে আগলে রেখেছে সুন্দরবন। দূষণের কারণে এ বনের জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে।

সুন্দরবনের উপ-প্রধান বনসংরক্ষক মঈনুদ্দিন খান বলেন, ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে দূষণ রোধে পর্যটকদের সচেতন করা হয় প্রতিনিয়ত। বনে অপরাধ দমনে বনবিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।

বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার সুন্দরবনে দূষণরোধ ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি থেকে ‘উত্তরণের পথ খোঁজা হচ্ছে’ জানিয়ে বলেন, সম্প্রতি শুরু হওয়া সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে বন সুরক্ষায় সুন্দরবনের ৩৩টি স্থানে স্থায়ী নমুনা প্লট স্থাপনের মাধ্যমে সেখানে লবণাক্ত জমিতে গাছের চারা জন্মানো, চারা মারা যাওয়া ও গাছের বৃদ্ধির তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এটা বন রক্ষায় সিদ্ধান্ত ও প্রকল্প গ্রহণে সহায়ক হবে।

উপমন্ত্রী বলেন, লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে বন্যপ্রাণীরা সুপেয় পানি সংকট রয়েছে। এজন্য বনে ৮৮টি পুকুর খনন-পুনঃখনন এবং ৩০টি পুকুরের পাকা ঘাট নির্মাণ করা হচ্ছে।