কুড়িগ্রামে ‘এক যুগ পর’ কাউন চাষে ফিরেও হোঁচট

‘এক যুগ বন্ধ থাকার’ পর উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ফসল কাউনের চাষ হলেও এবার পোকার আক্রমণে হোঁচট খেতে হয়েছে চাষিদের।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2021, 02:33 PM
Updated : 25 May 2021, 02:33 PM

কাউনের পায়েস এ অঞ্চলের জনপ্রিয় খাবার। অল্প পরিচর্যায় কাউন চাষ করাও যায়। এছাড়া পশু-পাখির খাদ্যে কাউন অথবা কাউনের চাল ব্যবহার হয়। কুড়িগ্রামের চরের মাটিও কাউন, চিনা, সরগম আবাদে খুবই উপযোগী।

ফলন ভালো না হওয়া, উচ্চ ফলনশীল জাতের কাউনের বীজের অভাব এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে প্রায় এক যুগ ধরে এসব এলাকায় কাউনের আবাদ প্রায় বন্ধ থাকে বলছেন কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা।

এ অঞ্চলে কাউনের জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে কৃষি বিভাগের বিশেষ উদ্যোগে গত বছর থেকে পুনরায় এ ফসল আবাদ শুরু হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাবে চলতি বছর কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে সাড়ে ৬শ হেক্টর জমিতে কাউনের আবাদ হয়েছে।

তবে চলতি মৌসুমে বিরূপ আবহাওয়া এবং কীটনাশক কাজ না করায় কাউন চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা স্বীকার করছে কৃষি বিভাগও।

কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর ফারাজী গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন (৩২) বলেন, “বাহে, বাপ-দাদারা আগোত কাউনের আবাদ করছিল। মাঝখানোত আবাদ বন্ধ হয়া যায়। গতবার থাকি মানুষের দেকাদেকি হামরাও আবাদ করছি। কিন্তু লেদা পোকা হামার সর্বনাশ করি দেইল।”

তিনি দুই বিঘা জমিতে কাউন চাষ করেছেন এবার। তার জমির ‘চল্লিশ ভাগ’ কাউন লেদা পোকার আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছে।

দুই বিঘায় আট হাজার টাকার উপরে খরচ করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “গায়ে গতরে কষ্ট করলং কিন্তু লাভ হইল না।”

চর ফারাজী পাড়া গ্রামের কৃষক বাচ্চু মিয়া (৫২) বলেন, “হামার পরিবারে ১৩ জন খাওয়াইয়া তিন বিঘা জমিত কাউন আর সাত বিঘা জমিত চিনা লাগাইছি। এগুলা দিয়ে সংসারের খারচ-খালা চালাই। কিন্তু কাউন আবাদ করি ধরা খায়া গেইলং।”

একই গ্রামের ছামাদ আলী (৬৫) এবং মোক্তার আলী (৫৫) দুই বিঘা করে চার বিঘা জমিতে কাউন চাষ করেন। প্রতি বিঘায় তাদের খরচ হয় চার হাজার টাকা।

সব ঠিকঠাক থাকলে উৎপাদন হয় ৭ থেকে ৮ মণ কাউন। প্রতিমণ কাউনের দাম ১২শ’ থেকে ১৩শ’ টাকা হলে প্রতি বিঘার কাউন বিক্রি করে নয় হাজার টাকা করে তাদের পাওয়ার কথা। হিসাব বলে এতে প্রতি বিঘায় তাদের চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা লাভ হতো।

তবে মোক্তার আলীর দুই বিঘা জমির মধ্যে ১৬ শতক জমিতে পোকার আক্রমণ হয়েছে। সেই ক্ষেতের ফসল কেটে এখন গরুকে খাওয়াচ্ছেন তিনি।

ওই গ্রামের শাহাবুদ্দির ছেলে শাহাদত (৪০) বলেন, কৃষি বিভাগের পরামর্শে কীটনাশক প্রয়োগ করেও কোনো কাজ হয়নি। বিষয়টি কৃষি বিভাগকে জানিয়েও প্রতিকার পাননি তারা।

কৃষক খয়বর আলী (৫৫) বলেন, “বাহে বিএস’র (উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা) কথাত ঔষধ ছিটালং কিন্তু কাজ তো হইল না। পোকাগুলো ২ থেকে ৩ ঘণ্টা টাসকি নাগি থাকার পর ফির উঠি কাউন খাবার ধরে। হামরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হইলং।”

এ বিষয়ে যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার জানান, চরাঞ্চলে বাপ-দাদার আমলে কাউন চাষ লাভজনক ফসল হলেও এক যুগ ধরে কাউন আবাদ বন্ধ করে দিয়েছে কৃষকরা। এর মূল কারণ কৃষকরা ফলনে বারবার ‘মাইর খেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে’ বলেন তিনি।

কৃষি বিভাগের পরামর্শে তার ইউনিয়নে গত দুই বছর থেকে আবার কাউনের আবাদ শুরু হয়েছে। এবার দেড়শ একর জমিতে কাউন চাষ হলেও এর ‘৩০ ভাগ পোকার আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়’।

কৃষকদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ‘কৃষি বিভাগ সঠিকভাবে দেখভাল’ আবশ্যক মনে করেন এ জনপ্রতিনিধি।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক জানান, স্থানীয় জাতগুলোতে পোকা দমনের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কীটনাশকও ঠিকমত কাজ করেনি।

এছাড়া ভালো ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আধুনিক জাতের বারি কাউন-৩ কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করাও হয়েছে বলেন তিনি।

রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক জিতেন্দ্র নাথ বলেন, চরাঞ্চলের প্রান্তিক মানুষ বিকল্প খাদ্য হিসেবে কাউন চাষ করে ভাতের অভাব মেটাতে পারবে।

তার শঙ্কা, বেশি টাকা ব্যয় করেও কৃষক যদি লাভবান হতে না পারে তাহলে এ জনপদ থেকে আবার এ ফসল হারিয়ে যেতে পারে।