সোমবার বিকালে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তরের সময় মাদারীপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের উপ পরিচালক তোফাজ্জেল হোসেন এই তথ্য জানিয়েছেন।
লকডাউনে নৌচলাচল বন্ধের মধ্যে পদ্মা পরাপারে এই স্পিডবোটটি চলছিল, আর যাত্রীও নিয়েছিল গাদাগাদি করে।
এই অনিয়ম চোখে না পড়া জন্য নৌচলাচল কর্তৃপক্ষ ও নৌপুলিশ পরস্পরকে দোষ দিচ্ছে।
উদ্ধারকর্মী ও স্থানীয়রা জানায়, পদ্মার ওপারে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট থেকে আসা স্পিডবোটটি সকাল ৭টার দিকে শিবচরের কাঁঠালবাড়ী (পুরাতন ফেরিঘাট) ঘাটের কাছে নদীর পাড়ে নোঙ্গর করে রাখা একটি বাল্কহেডের (বালুবাহী নৌযান) পেছনে ধাক্কা লেগে দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
এতে সব যাত্রী পদ্মায় ডুবে যায়। পাঁচজনকে স্থানীয়রা জীবিত উদ্ধার করে। পরে নৌপুলিশ, সেনাসদস্য, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা উদ্ধার অভিযান চালিয়ে শিশুসহ ২৬ জনের লাশ উদ্ধার করে।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা তোফাজ্জেল বলেন, “উদ্ধারকৃত ২৬ লাশের প্রতিটির মাথায়ই মারাত্মক জখমের দাগ দেখা গেছে। লাশ হস্তান্তরকালেও রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। এছাড়া কোনো লাশের শরীরেই লাইফ জ্যাকেট ছিল না।”
চলছিল ৩১ যাত্রী নিয়ে
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, কান্দু মোল্লা ও জহিরুল ইসলামের মালিকানাধীন এই স্পিডবোটটি ৩১ জন যাত্রী নিয়ে চলছিল। এটি চালাচ্ছিলেন শাহ আলম নামে একজন।
এই পথে স্পিডবোট নিয়মিত চললেও এগুলোর অনুমোদন নেই। তবে অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
লকডাউনের মধ্যে এই স্পিডবোট চলাচল করা নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এটি শিমুলিয়া ঘাট থেকে ছাড়েনি, স্পিডবোটটির চালক চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ‘গোপনে’ যাত্রী তুলে পারাপার করছিল।
“শিমুলিয়া ঘাট তো তালা মারা। ওই ঘাট দিয়ে কোনো নৌযান চলাচল করছে না। লঞ্চগুলোও ঘাটে নোঙর করা।”
তবে ঘাট থেকেই স্পিডবোটটি ছেড়েছিল বলে স্থানীয়দের ভাষ্য। আর জেলা প্রশাসকও তাই বলেছেন।
স্পিডবোট চলাচল দেখার দায়িত্ব নৌপুলিশের বলে বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তারা দাবি করলেও নৌ পুলিশ কর্মকর্তারা উল্টো বলছেন, ঘাট ইজারা তো বিআইডব্লিউটিএ দেয়।
স্থানীয়দের কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, লকডাউনের মধ্যে শিমুলিয়া ঘাট থেকে প্রকাশ্যেই টিকিট কেটে চলছে স্পিডবোটগুলো। শিমুলিয়া ঘাটের ইজারাদার ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ হোসেন এবং বাংলাবাজার ঘাটের ইজারাদার ইয়াকুব বেপারি।
তারা দুজনই আওয়ামী লীগের নেতা। এ বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়ছে।
স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর
উদ্ধার করা ২৬ জনের লাশ শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের দোতারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে রাখা হয়। সেখানে স্বজনদের কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়।
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কমর্কর্তা মো. আসাদুজ্জামান নিহতদের পরিচয় প্রকাশ করেন।
নিহতরা হলেন- খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার বারুখালির মনির মিয়া (৩৮), হেনা বেগম (৩৬), সুমী আক্তার (৫) ও রুমি আক্তার (৩), ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার চরডাঙা গ্রামের বাবা আরজু শেখ (৫০), ইয়ামিন সরদার (২), মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার সাগর ব্যাপারী (৪০), কুমিল্লা দাউদকান্দির কাউসার আহম্মেদ (৪০), রুহুল আমিন (৩৫), মাদারীপুর জেলার রাজৈরের তাহের মীর (৪২), কুমিল্লার তিতাসের জিয়াউর রহমানের (৩৫), মাদারীপুরের শিবচরের হালান মোল্লা (৩৮), শাহাদাত হোসেন মোল্লা (২৯), বরিশালের তেদুরিয়ার আনোয়ার চৌকিদার (৫০), মাদারীপুর রায়েরকান্দির আব্দুল আহাদ (৩০), চাঁদপুর জেলার উত্তর মতলব উপজেলার মো. দেলোয়ার হোসেন (৪৫), নড়াইল লোহাগড়া উপজেলার রাজাপুর জুবায়ের মোল্লা (৩৫), মুন্সিগঞ্জ সদরের সাগর শেখ (৪১), বরিশাল মেহেন্দিগঞ্জের সায়দুল হোসেন (২৭), রিয়াজ হোসেন (৩৩), ঢাকা পীরেরবাগ এলাকার খেরশেদ আলম (৪৫), ঝালকাঠির নলছিটির এসএম নাসির উদ্দীন (৪৫), বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের মো. সাইফুল ইসলাম (৩৫), মনির হোসেন জমাদ্দারের (৩৫), পিরোজপুরের চরখামার মো. বাপ্পি (২৮), পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার জনি অধিকারী (২৬) ।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক কমডোর জালালউদ্দিন আহমেদ, বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক রফিকুল ইসলাম, মাদারীপুর জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন, পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল, উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ মোল্লা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
লাশ হস্তান্তরের সময় পরিবার প্রতি নগদ ২০ হাজার করে আর্থিক অনুদান দেন জেলা প্রশাসক।