রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন: মৃত্যু নিয়ে সরকার ও ইউএনএইচসিআরের তথ্য ভিন্ন

কক্সবাজারের উখিয়ায় বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা নিয়ে সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর ভিন্ন তথ্য দিয়েছে।

কক্সবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2021, 06:37 PM
Updated : 23 March 2021, 06:37 PM

ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মহসিন।

নিহতদের মধ্যে সাত জনের পরিচয় পাওয়ার কথা জানালেও তিনি বাকি চার জনের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি।

এদিকে, ইউএনএইচসিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এই আগুনে ১৫ জন নিহত ও ৫৬০ জন আহত হয়েছে; নিখোঁজ রয়েছে ৪০০ জন।

এছাড়া, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এই ঘটনায় ১১ জন নিহত, ৫০০ জন আহত হয়েছে এবং আনুমানিক ৪০০ জন নিখোঁজ রয়েছে।

সরকার ও আন্তর্জাতিক এই দুই সংস্থা ঘরহারা মানুষের সংখ্যা আনুমানিক ৪৫ হাজার বললেও পরিবারের সংখ্যা নিয়ে তাদের তথ্যে ভিন্নতা রয়েছে।  

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৯ হাজার ৩০০টি, লার্নিং সেন্টার ১৩৬টি, হাসপাতাল দুইটি।

কিন্তু ইউএনএইচসিআর ও আই্ওএম বলছে, ১০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মঙ্গলবার সকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মহসিন উখিয়ার বালুখালীতে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।

পরে বিকাল ৫টায় কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১১; এই ঘটনায় খুবই কম সংখ্যক মানুষ আহত হয়েছে। আর যারা আহত হয়েছে কেউ শংকাজনক অবস্থায়ও নেই।”

মোহাম্মদ মহসিন বলেন, আগুন লাগার ঘটনায় চারটি ক্যাম্পের ৯ হাজার ৩০০ পরিবারের আনুমানিক ৪৫ হাজার মানুষ, ১৩৬টি লার্নিং সেন্টার ও দুইটি হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় বাসিন্দাদের বসতঘরসহ দুই শতাধিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রেস ব্রিফিংয়ে কেউ নিখোঁজ রয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে সাংবাদিকদের মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ঘটনার তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের পর এ ব্যাপারে জানা যাবে। কেউ কেউ হয়ত আশপাশের ক্যাম্পে আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতদের ঘরে আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে। আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব হবে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান সচিব মহসিন।

কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যবাসন কমিশনার শাহ মো. রেজওয়ান হায়াতকে। সদস্যরা হলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী বিষয়ক সেলের প্রধান (যুগ্ম-সচিব) মো. হাসান সারওয়ার, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের একজন প্রতিনিধি, জেলা পুলিশ সুপারের একজন প্রতিনিধি, কক্সবাজারের ১৪ আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক (এসপি), বালুখালীর ৮-ডব্লিউ ক্যাম্পের ইনচার্জ, কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক এবং অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. খলিলুর রহমান খান।

তদন্ত কমিটিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটন এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান মোহাম্মদ মহসিন।

তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাসিন্দারা যাতে খাদ্য সংকটে না পড়ে সেই জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে  নগদ ১০ লাখ টাকা এবং ৫০ মেট্রিক টন চাল তাৎক্ষণিক বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৩ হাজার ৮০০ রোহিঙ্গা পরিবারকে অন্য ক্যাম্পে আশ্রয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঘটনাস্থলে ৮০০টি অস্থায়ী তাঁবু স্থাপন করে ক্ষতিগ্রস্তদের আপাতত আশ্রয়েরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব আরও জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডে আগুনের সূত্রপাতের কারণ এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর প্রকৃত কারণ জানানো সম্ভব হবে।

সোমবার বিকাল ৪টায় উখিয়ার বালুখালী ৮-ডব্লিউ ক্যাম্প থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা পাশের ৯, ১০ ও ১১ নম্বর ক্যাম্পেও ছড়িয়ে পড়ে বলে জানান অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু-দৌজা নয়ন।

তিনি বলেন, “ক্যাম্পের বসত ঘরগুলো ঝুপড়ির মত লাগোয়া হওয়ায় এবং সে সময় বাতাসের গতি বেশি থাকায় আগুন দ্রুত ছড়ায়। আগুন লাগার সাথে সাথে স্বেচ্ছাসেবক কর্মীরাসহ স্থানীয়রা আগুন নেভানোর চেষ্টা চালায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কমিরাও আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে যোগ দেয়। ”

কক্সবাজারের ১৪ আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক (এসপি) আতিকুর রহমান জানিয়েছেন, আগুন লাগার খবরে ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, এপিবিএন ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা ৫ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চেষ্টায় সোমবার রাত সোয়া ৯টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

এদিকে, সোমবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লাগার পরপরই উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালীতে আবুল কাশেম চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে এনজিওদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক খোলা হয় একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র।

এতে দায়িত্ব পালনকারী বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রঞ্জু মিয়া বলেন, “সোমবার বিকাল থেকে সামান্য ও গুরুতর আহত অন্তত দুই হাজারের কেশি রোহিঙ্গা স্বাস্থ্য কেন্দ্রটিতে ভর্তি হয়েছে। পরে অধিকাংশ জনই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেলেও গুরুতর আহত অল্প কয়েকজনকে অন্যত্রে পাঠানো হয়েছে।”

বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ক্ষতিগ্রস্ত বলিবাজার এলাকায় অস্থায়ীভাবে স্থাপিত এনজিও সংস্থা ব্র্যাকের চাইল্ড প্রটেকশন প্রকল্পের সিএসএফ কর্মকর্তা মো. সোহেল রানা জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া শিশুদের সন্ধানে সংস্থাটির ৩০০ জন স্বেচ্ছাসেবী কর্মি কাজ করছেন। মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত সংস্থাটির কাছে দেড়-শতাধিক নিখোঁজ থাকার তথ্য তারা পেয়েছেন। এদের মধ্যে আট জনকে উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

তিনি বলেন, “এখনও অনেক শিশু নিখোঁজ তথ্য সংস্থাটির কাছে আসা অব্যাহত রয়েছে। নিখোঁজের এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।”

এদিকে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সার্বিক চিত্র নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর এর সহকারী জনসংযোগ কর্মকর্তা মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন স্বাক্ষরিত একটি এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম এর জনসংযোগ কর্মকর্তা তারেক মাহমুদ স্বাক্ষরিত আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি কক্সবাজারের স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।

এতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাসহ ক্ষয়ক্ষতির যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে সাংবাদিকদের কাছে প্রেস ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে কিছুটা গরমিল রয়েছে।

ইউএনএইচসিআরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মৃতের সংখ্যা ১৫, আহত হয়েছে ৫৬০ জন এবং নিখোঁজ রয়েছে ৪ শতাধিক। আর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার এবং মানুষের সংখ্যা ৪৫ হাজার।

আইওএম-এর পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মৃতের সংখ্যা ১১ জন, আহত হয়েছে ৫০০ এবং নিখোঁজ রয়েছে ৪০০ জন। এছাড়া ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার প্রায় ১০ হাজার এবং মানুষের সংখ্যা ৪৫ হাজার।