আসবাবপত্র অলংকরণে যন্ত্র, ঘুরিয়ে দিচ্ছে কারিগরদের জীবন

কাঠের আসবাবপত্র অলংকরণে কম্পিউটার চালিত যন্ত্রের ব্যবহার এই পেশায় জড়িত কাগিরদের জীবন পাল্টে দিচ্ছে।

আসাদুজ্জামান আসাদ, বেনাপোল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2021, 04:19 AM
Updated : 23 March 2021, 04:20 AM

হাতে আঁকা ছবির উপর বাটালি-হাতুড়ি দিয়ে কাঠের আসবাবপত্রে নকশা তৈরি শত শত বছর ধরে চাহিদা মিটিয়েছে শৌখিন মানুষদের।

তার মধ্যেই আসবাবপত্র অলংকরণে এখন যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে। কম্পিউটারে ছবি এঁকে কম্পিউটার চালিত যন্ত্রের সাহায্যে তাতে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে নিখুঁত আলপনা। এতে কাজটা যেমন সুন্দর হচ্ছে, তেমনি সময়ও কমেছে অনেক। তাই খরচও কমে যাচ্ছে।

আগে এই পেশায় যুক্ত অনেকেই তেমন আয় রোজগার করতে না পারলেও এখন এই নকশা-শিল্পীরা তাদের দিন বদলে ফেলছেন যন্ত্রের ব্যবহারে।

যশোরের শার্শা উপজেলার বেনাপোল, নাভারন, শার্শা, বাগআচড়া ও জামতলা বাজারে কাঠের আসবাবপত্রের দোকানগুলোতে এই ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপকভাবে।

শার্শার জামতলা বাজারে ১০০ জনের মতো এই পেশায় যুক্ত আছেন। এই কাজের মাধ্যমে তারা তাদের আর্থিক অবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন করতে পেরেছেন। 

এই শিল্পের কারিগররা বলছেন, বংশ পরস্পরায় এই পেশায় এসেছেন তারা। আগে তেমন আয় ছিল না। কিন্তু এখন যন্ত্রে নকশা তুলে যে আয় হয় তাতে খেয়ে পরে ভালো আছেন। জায়গা-জমি কিনে, ঘরবাড়ি করেছেন; ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন।

সরেজমিনে জামতলা বাজার ঘুরে জানা যায়, আগে অনেকেই আসবাবপত্র তৈরি করে বিক্রি করলেও এখন তাদের কেউ কেউ তা ছেড়ে দিয়েছেন। তারা এখন শুধু ক্রেতাদের কিম্বা ফার্নিচার দোকানিদের দেওয়া কাঠের ওপর নকশা করে দেন।

এই নকশা তৈরির কাজে যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয় সেটাকে কেউ বলে ‘বগা মেশিন’, কারো ভাষায় ‘জিগির মেশিন’। তবে তার পোশাকী নাম হলো 'রোটার'। কম্পিউটার চালিত এই রোটার কাগিরদের সময় কমিয়েছে; সুযোগ ও আয় বৃদ্ধি করেছে।

এক সময় অভাবের সংসারে কষ্টে কাটত সামটা গ্রামের রাজমিস্ত্রি নজরুল ইসলামের পরিবারের সদস্যদের। তার ছেলে মনির হোসেন অষ্টম শ্রেণি থেকে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে কাঠমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজে যোগ দেন। বাবা রাজমিস্ত্রি হলেও ছেলে আসবাবপত্রের মিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে সংগ্রামী জীবন শুরু হয়।

এখন তিনি নিজে প্রতিষ্ঠা করেছেন 'রাকিব নকশা ঘর'। এখন উপজেলায় তিনি খ্যাতিমান নকশা মিস্ত্রি।

মনির হোসেন বলেন, যশোর ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ তার কাছে আসে টেবিল, চেয়ার, খাট, পালঙ্ক, আলমারি, দরজা-জানালার কাঠে নকশা খোদায় করতে।

তার হাত ধরে এলাকার অন্তত ১০০ জন এই পেশায় এসেছে বলে তিনি জানান।

“জীবনে অনেক কষ্ট করিছি। তার সুফল পাইছি। এই কাজ করে জমি কিনিছি, পাকা বাড়ি করিছি। বিয়ে করিছি। সন্তানের লেখাপড়া শেখাচ্ছি। আল্লাহ ভাল রেখেছে। নিজ হাতে কাজ করি। তাই ভালো কাজের আশায় এখনও দূরদূরান্তের মানুষ আসে।”

মনির জানান, যন্ত্র ব্যবহারে সময় ও পরিশ্রম কম, কিন্তু সুবিধা বেশি। তারপরও কাঠ জোড়া দেওয়াসহ হাতে যে কাজটুকু করার কথা, তা তিনি নিজেই করেন। তার অধীনে কাজ করছেন পাঁচ জন। আরিফ, রিপন, শুভ, ইশান ও মাছুম ছোটো আকারের যন্ত্রে কাজ করেন। 

"আগে হাতেই সব কাজ করতাম। পরে কাজ শিখে ১০ হাজার টাকায় একটি নকশা করার ‘রোটার যন্ত্র’ কিনেছি। বেশ ভালো ফল পাচ্ছি।”

জামতলা বাজারের আজিজুল ইসলাম (৪০) নামের এক ব্যক্তিও মনিরের প্রশংসা করেন।

তার মতে, যন্ত্রের সাহায্যে আসবাবপত্রে কারুকাজ করার জন্য খ্যাতিমানদের একজন হলেন মনির। তিনি আসবাবপত্রে ফুল, প্রকৃতি, পশু-পাখির নকশা তৈরি করেন। আপনজনদের প্রতিকৃতি খোদাই করার কাজও করেন।

আজিজুল বলেন, এখন আর হাতে নকশা করা হয় না। যে কাজ আগে হাতে করলে লাগত ত্রিশ ঘণ্টা, এখন লাগে প্রায় অর্ধেক সময়।

তবে যন্ত্রের ব্যবহারে ঝুঁকি আছে জানিয়ে তিনি বলেন, যন্ত্র চালাতে ভুল হলে কাঠ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়া বৈদ্যুতিক সংযোগ দিয়ে কাজ করতে হয় বলে কাজের সময় সাবধানী হতে হয়।

টেংরা গ্রামের কারিগর মুছা করিম (৪২) বলেন, তিনজন লোক কাজ করলে আগে একটা বক্সখাট তৈরি করতে সময় লাগত ৮দিন। এখন লাগে চার দিন। এতে তিন জনের চার দিনের মুজুরি বাঁচে। তবে নকশা কাটাতে খরচ হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।

গোড়পাড়া বাজারের আসবাবপত্র মিস্ত্রী ও দোকানমালিক আব্দুল মালেক বলেন, “আমি ফার্নিচার তৈরি করে বিক্রি করি। নিজ হাতে কাজ করি। রোটার আমার নেই, তাই অন্যের কাছ থেকে নকশা কেটে আনি। তবে ছোটোখাট নকশা বাটালি দিয়ে নিজেই তৈরি করি।”

তবে তার মতো অনেক মিস্ত্রি তার গোলা থেকে কাঠ কেনার পর সরাসরি যন্ত্র ব্যবহারের কারখানায় নিয়ে যান বলে তিনি জানান। 

বাগআচড়া বাজারের কাঠমিস্ত্রি আবু বক্কর ছিদ্দিক (৩৫) প্রায় চার লাখ টাকা খরচ করে 'কম্পিউটার রোটার' যন্ত্রের মাধ্যমে নকশা কাটার কাজ করছেন বলে জানান।

যশোর ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসবাবপত্র তৈরির কাজ পান বলেও জানান তিনি।

আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, “কাঠের আসবাবপত্রে হাতের কাজ উঠেই যাচ্ছে। নকশা বলতেই এখন যন্ত্রের নকশা। রোটার যন্ত্র দিয়ে কম্পিউটারের সাহায্যে নকশা কাঠে তৈরি করে দিচ্ছি।”

প্রতিদিন অন্তত ৩০ হাজার টাকার নকশা এই যন্ত্রের সাহায্যে কাটা সম্ভব বলে তিনি জানান।