বন্দর ব্যবহারকারীদের ভাষ্য, রেলে পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগ কমেছে, সময় বেঁচেছে এবং সীমান্ত বাণিজ্যের গতি বেড়েছে। বেনাপোল বন্দরে সরকারের রাজস্ব আদায়ও পরিমাণ বেড়েছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের আইন বিষয়ক সম্পাদক মশিয়ার রহমান বলেন, ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে দুই দেশের কাস্টমস, রেল মন্ত্রণালয় ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে নীতি নির্ধারকরা ২০২০ সালের ৪ জুন রেলপথে সব ধরনের পণ্য আমদানির অনুমতি দেয়।
"করোনার আগে বেনাপোলে কেবল 'কার্গো রেলের' মাধ্যমে ভারত থেকে সপ্তাহে একটি বা দুটি ট্রেন আসত। আবার কখনও কখনও দেখা গেছে মাসে একটি ট্রেনও আসেনি। কিন্তু বর্তমানে চিত্র ভিন্ন। প্রতিদিন 'কার্গোরেল, সাইডোর কার্গোরেল এবং প্যার্সেল ভ্যানের' মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হচ্ছে।”
বেনাপোল রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার শাহিদুজ্জামান বলেন, “বর্তমানে ভারত থেকে স্থলপথের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রেলপথে পণ্য আমদানি হচ্ছে। বেনাপোল স্থলবন্দর রেলপথে ২০২০-২১ অর্থবছরে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ভারত থেকে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪৫৪ দশমিক ৩ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। অথচ গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই পথে ভারত থেকে পণ্য আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩ দশমিক ৯ মেট্রিক টন।”
রেল ও ট্রাকে পণ্য পরিবহনের সময় ও ভাড়ার পার্থক্য সম্পর্কে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মুক্তা টেড্রিং কর্পোরেশনের মালিক আব্দুল মুন্নাফ বলেন, একটি ট্রাক ৩৫ থেকে ৪০ মেট্রিক টন ফেব্রিক্স বোঝাই করে ভারতের আমেদাবাদ থেকে বনগাঁ পার্কিং পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগে ৬/৭ দিন। এরপর পার্কিং থেকে বাংলাদেশ গেইট পাশ করে প্রবেশ করতে লাগে আরও ৬ থেকে ৮ দিন। ট্রান্সপোর্ট ভাড়া ১ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ রুপি। ডিটেনশন প্রতিদিন ৩৫০০ রুপি।
বেনাপোলের আরেক ব্যবসায়ী এমএম ইন্টারন্যাশনালের প্রোপ্রাইটার মেহেরউল্লাহ বলেন, রেলে পণ্য আমদানিতে সময় কম লাগে; তুলনামূলক খরচ কম এবং পণ্যের যথেষ্ট নিরাপত্তা রয়েছে।
"ভারতের রানাঘাট থেকে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর বেনাপোল বন্দরে সেই পণ্যচালান পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র ৩ ঘণ্টা থেকে এক দিন। কিন্তু সড়ক পথে বনগাঁ থেকে বেনাপোল একটি ট্রাক পৌঁছতে সময় লাগে ১৫ থেকে ১৮ দিন। প্রতিদিন ডিটেনশন দিতে হয় ২৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা।"
মেহেরুল্লাহ আরও জানান, ভারত থেকে রেল ওয়াগন, কন্টেইনার, কার্গো ও রেল টানেলের মাধ্যমে পণ্য আনা হচ্ছে। রেল বিভাগের ওয়াগনে আনা পণ্য চালানে খরচ কম হয়। কন্টেইনার কিংবা টানেলের মাধ্যমে পণ্য আনতে খরচ একটু বেশি।
রেলে পণ্য আমদানি বাড়ার কারন সম্পর্কে বেনাপোল সিএন্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান বলেন, ট্রাকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারতীয় সিন্ডিকেট জিম্মি করে রেখেছে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ পৌরসভা কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনা, আমদানি-রপ্তানিতে নাক গলানো, পৌরসভার কালিতলা পার্কিং সৃষ্টি করে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা ট্রাকগুলো জোরপূর্বক পেট্রাপোল বন্দরের সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউস কর্পোরেশনের টার্মিনালে না পাঠিয়ে চাঁদার জন্য কালিতলা পার্কিংয়ে রেখে দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
“তাই তারা সড়ক পথে ট্রাক বাদ দিয়ে এখন রেলে পণ্য আমদানির দিকে ঝুঁকছেন।”
তারপরও দু'দিন পর পর নানা অজুহাতে ধর্মঘটের কারণে অতিষ্ঠ দুদেশের ব্যবসায়ীরা।
ওখান থেকে প্রতিদিন নিজেদের ইচ্ছে মতো কবে কোন ট্রাক বেনাপোলে যাবে তা তারাই নির্ধারণ করে দেওয়ালে কাগজ সেঁটে দেয়। দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে আমদানিকৃত পণ্যগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপরও শিল্পের কাঁচামাল সময়মতো কারখানায় পৌঁছাতে না পারায় শিল্প কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে।
কন্টেইনার ট্রেনে করে ভারত থেকে পণ্য আমদানি করা ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল জানিয়ে বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ভারতীয় ট্রাক পার্কিং সিন্ডিকেট জিম্মি করে রেখেছে।
“ভারতীয় হাই কমিশনারসহ বিভিন্ন মহলে আবেদন করার পরও আমরা কোনো সমাধান পাচ্ছি না। বর্তমানে রেলপথে সব ধরনের পণ্য আমদানির অনুমতিতে ব্যবসায়ীরা খুশি। ঝক্কি ঝামেলা না থাকায় রেলপথে আমদানিকারকরা পণ্য আমদানি করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করছেন।”
বেনাপোল বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক মামুন কবীর তরফদার বলেন, রেলের প্রতি ব্যবসায়ীদের আস্থা বাড়ায় পণ্য আমদানি সহজ হয়েছে। এসব পণ্যচালান আগে ট্রাকে আসত। রেলপথে পণ্য আমদানি হওয়ায় বেনাপোলে ট্রাকজট কমায় যানজটও কমেছে, বেড়েছে আমদানি। সরকারও বেশি রাজস্ব পাচ্ছে।
বেনাপোল শুল্কভবনের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, রেল কন্টেইনারের মাধ্যমে আমদানি শুরু হওয়ায় দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। রেলপথে আসা পণ্য থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ২৬১ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। অথচ ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছিল মাত্র ৮ কোটি ৮৮ লাখ ২৬ হাজার টাকা। চলতি অর্থবছরে এটি বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কমিশনার আজিজুর রহমান আরও বলেন, রেল কন্টেইনারের মাধ্যমে আমদানি বাণিজ্য শুরুতে আমাদের স্টেইকহোল্ডারসহ সব ব্যবসায়ী খুশি। এতে সময় ও খরচ যেমন বাঁচবে তেমনি পণ্যের যথেষ্ট নিরাপত্তাও রয়েছে। ভারত থেকে রেলযোগে মালামাল আসাতে রেল খাতেও উন্নয়ন হবে। বন্দর একটি চার্জ পাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের খরচখরচাও কম হবে।