দখলে দূষণে বিবর্ণ কাপ্তাই হ্রদ

দখল আর দূষণে কাপ্তাই হ্রদের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য দিন দিন রং হারাচ্ছে।

ফজলে এলাহী রাঙামাটি প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2021, 04:29 AM
Updated : 10 Feb 2021, 04:47 AM

হ্রদ-পাহাড়ের পার্বত্য শহর রাঙামাটিকে তিনদিক থেকে ঘিরে আছে বিশাল এই জলরাশি। ষাটের দশকে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের পর এ হ্রদের সৃষ্টি হয়।

হ্রদের উপর দিয়ে রাঙামাটি জেলা সদর থেকে অন্তত সাতটি উপজেলায় পৌঁছতে হয়, যার মধ্যে পাঁচটিতে পৌঁছানোর একমাত্র পথই এই হ্রদের বুকের নৌপথ।

মূলত রাঙামাটি জেলাতেই জলাধারটি সীমিত, যা বিস্তৃত রয়েছে রাঙামাটি সদর, কাপ্তাই, নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলায়।

পানি দূষণের কারণে এই হ্রদে মাছের উৎপাদন কমে এসেছে। জনস্বাস্থ্যের জন্যও হ্রদের পানি ক্ষতিকর হয়ে উঠছে।

এই হ্রদে বর্তমান ৭৩ প্রজাতির মাছের বাস, যার মধ্যে ব্যাপকভাবে আহরিত হয় অন্তত ৩৪ প্রজাতির। ছোটো মলা, ঢেলা, কাচকি ও চাপিলার সঙ্গে বড়ো বড়ো রুই, কাতলা, বোয়ালও রয়েছে এখানে।

এই জেলায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে আছে হ্রদে নৌভ্রমণ কিংবা হ্রদের জলরেখা ধরে কাপ্তাই, সুভলং, বরকল কিংবা লংগদু ঘুরে বেড়ানো। বিশাল নীল জলরাশি, চারপাশে বিস্তৃত বিশাল বিশাল সবুজ পাহাড়-সবকিছু মিলে চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এই হ্রদ ঘিরে।

কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ধীরলয়ে বদলে যাচ্ছে হ্রদের চিত্র। হ্রদের পার ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে বহুতল অট্টালিকা, বাড়িঘর, হোটেল, মোটেল প্রভৃতি।

এসবের বর্জ্যও নির্বিবাদে পড়ছে হ্রদে। এ নিয়ে তেমন প্রতিবাদ প্রতিরোধও দেখা যায় না।

সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের রিজার্ভ বাজারের চারপাশে যে যার খুশিমতো ভবন নির্মাণ করেছে হ্রদের জমি দখল করে। এসব স্থাপনা ও ভবনের মধ্যে অনেকগুলোরই আবার বাজারফান্ডের বন্দোবস্তিও আছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া, শহরের গর্জনতলী, বনরূপা, তবলছড়ি, আসামবস্তি সর্বত্রই ব্যাপকহারে চলছে দখলবাজি।

শুধু দখলই নয়, এসব বসতবাড়ির বর্জ্য ও পয়ঃ সবই নিক্ষেপ হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদে।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য থেকে দেখা গেছে, ১৯৬৬ সালে মোট মাছ উৎপাদনের মধ্যে বড় মাছের অংশ ছিল ৭৮ শতাংশ। ১৯৯৩ সালে তা ২ শতাংশে নেমে এসেছে। এছাড়া প্রতিদিন এই হ্রদে ৫ টনের বেশি মনুষ্য বিষ্ঠা ও অন্যান্য বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। হ্রদের চারপাশের ৮৫ শতাংশ মানুষই পানীয় জল, রান্না, ধোয়া-মোছা, গোসল ইত্যাদির জন্যে এর পানির ওপর নির্ভরশীল। তাই জনস্বাস্থ্যের প্রতিও হুমকি বৃদ্ধি পেয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ রাঙ্গামাটি শহরে যে পানীয় জল সরবরাহ করছে তাতেও জীবাণুর অনুপাত গ্রহণযোগ্য মাত্রার অনেকগুণ বেশি বলে বাংলাপিডিয়া থেকে জানা গেছে। 

রাঙামাটি সরকারি কলেজের সাবেক জিএস ও নাগরিক আন্দোলনের কর্মী জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কাপ্তাই হ্রদ দখল বন্ধে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা এই জেলার রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তারাই সবচেয়ে কম দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। এসব রোখার যেনো কেউই নেই।

রাঙামাটির প্রবীণ সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে বলেন, এই হ্রদের উপর ভূমি বন্দোবস্তি দিয়ে প্রকারান্তরে হ্রদ দখলের সহযোগী হিসেবে সবচেয়ে বড় অপকর্মটি করছে বাজারফান্ড প্রশাসন। সমতলের সাথে পাহাড়ের ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির সুযোগ অপব্যবহার করে এই প্রতিষ্ঠান দায়িত্বহীন কার্যক্রমের কারণে হ্রদের তীরবর্তী স্থানে বসতবাড়ি, দালানকোটা গড়ে উঠছে।

এখনই যদি এসব বন্ধ করা না যায়, তবে ভবিষ্যতে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে বলে তিনি মনে করছেন।

রাঙামাটি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ললিত সি চাকমা বলেন, হ্রদ ব্যবস্থাপনায় যারা জড়িত আছেন তাদের আরও সচেতন হতে হবে। যেসব বিভাগ ও সংস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই হ্রদের উপকারভোগী তাদেরও নিজ কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে।

“ভুলে গেলে চলবে না এই হ্রদ এখন জেলাবাসীর খাবার, ব্যবহার্য পানির যেমন প্রধান উৎস, তেমনি নৌ যোগাযোগেরও একমাত্র মাধ্যম।”

পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজ রাঙামাটির পরিচালক হেফাজত উল বারি সবুজ বলেন, এই শহরে হ্রদ দখল করা ‘ফ্যাশন’, আর ঘরের যাবতীয় বর্জ্য হ্রদের জলে ফেলা ‘প্যাশন’। এসব বন্ধ করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ যেমন জরুরি তেমনি এই হ্রদ ব্যবস্থাপনায় একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণও জরুরি।

সেইসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরকেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

এলাকাবাসী জানায়, পার্বত্য জেলা পরিষদ স্বয়ং হ্রদের জায়গা দখল করে শহরের শহীদ মিনার এলাকায় ফাইভস্টার হোটেলের উদ্যোগ নেয়; পরে জেলা প্রশাসনের বাধায় তা ব্যর্থ হয়।

এছাড়া, পার্বত্য জেলা পরিষদ রিজার্ভবাজার এলাকায় শহীদ আব্দুল আলী একাডেমির সামনে লেকের উপর বানিজ্যিক কমিউনিটি সেন্টারের বহুতল ভবন নির্মাণ করছে।

শুধু রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদই নয়, হ্রদে দুষণ বা দখলে রাঙামাটি পৌরসভাও কম যায় না। পৌরসভার মালিকানাধীন পৌর মার্কেট নির্মিত হয়েছে হ্রদের প্রবাহের উপরই! একই সাথে বর্তমানে নির্মাণাধীন পৌরভবনটিও নির্মিত হচ্ছে হ্রদের উপর।

তবে হ্রদ রক্ষায় রাঙামাটি জেলা প্রশাসনকে মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে দেখা যায়।

নির্মাণাধীন পাঁচতলা হোটেলের কাজ, ফ্রেন্ডস ক্লাব ভবন নির্মাণ, ফায়ার সার্ভিস ও আসামবস্তি এলাকায় হ্রদ দখল করে নির্মিত একাধিক ভবনের নির্মাণ কাজ বন্ধ করেছে তারা গত এক বছরে।

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশীদ বলেন, “আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাই করি এই হ্রদকে রক্ষা করতে। কিন্তু এই ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষকে। আমরা তো এককভাবে অনেক কিছুই করতে পারি না, সম্ভবও নয়।”

১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণ শুরু করে যা ১৯৬২ সালে শেষ হয়। এর ফলে পরবর্তীতে এখানে বিশাল জলরাশির কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হয়।