হ্রদ-পাহাড়ের পার্বত্য শহর রাঙামাটিকে তিনদিক থেকে ঘিরে আছে বিশাল এই জলরাশি। ষাটের দশকে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের পর এ হ্রদের সৃষ্টি হয়।
হ্রদের উপর দিয়ে রাঙামাটি জেলা সদর থেকে অন্তত সাতটি উপজেলায় পৌঁছতে হয়, যার মধ্যে পাঁচটিতে পৌঁছানোর একমাত্র পথই এই হ্রদের বুকের নৌপথ।
মূলত রাঙামাটি জেলাতেই জলাধারটি সীমিত, যা বিস্তৃত রয়েছে রাঙামাটি সদর, কাপ্তাই, নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলায়।
পানি দূষণের কারণে এই হ্রদে মাছের উৎপাদন কমে এসেছে। জনস্বাস্থ্যের জন্যও হ্রদের পানি ক্ষতিকর হয়ে উঠছে।
এই জেলায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে আছে হ্রদে নৌভ্রমণ কিংবা হ্রদের জলরেখা ধরে কাপ্তাই, সুভলং, বরকল কিংবা লংগদু ঘুরে বেড়ানো। বিশাল নীল জলরাশি, চারপাশে বিস্তৃত বিশাল বিশাল সবুজ পাহাড়-সবকিছু মিলে চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এই হ্রদ ঘিরে।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ধীরলয়ে বদলে যাচ্ছে হ্রদের চিত্র। হ্রদের পার ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে বহুতল অট্টালিকা, বাড়িঘর, হোটেল, মোটেল প্রভৃতি।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের রিজার্ভ বাজারের চারপাশে যে যার খুশিমতো ভবন নির্মাণ করেছে হ্রদের জমি দখল করে। এসব স্থাপনা ও ভবনের মধ্যে অনেকগুলোরই আবার বাজারফান্ডের বন্দোবস্তিও আছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া, শহরের গর্জনতলী, বনরূপা, তবলছড়ি, আসামবস্তি সর্বত্রই ব্যাপকহারে চলছে দখলবাজি।
শুধু দখলই নয়, এসব বসতবাড়ির বর্জ্য ও পয়ঃ সবই নিক্ষেপ হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ রাঙ্গামাটি শহরে যে পানীয় জল সরবরাহ করছে তাতেও জীবাণুর অনুপাত গ্রহণযোগ্য মাত্রার অনেকগুণ বেশি বলে বাংলাপিডিয়া থেকে জানা গেছে।
রাঙামাটি সরকারি কলেজের সাবেক জিএস ও নাগরিক আন্দোলনের কর্মী জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কাপ্তাই হ্রদ দখল বন্ধে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা এই জেলার রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তারাই সবচেয়ে কম দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। এসব রোখার যেনো কেউই নেই।
এখনই যদি এসব বন্ধ করা না যায়, তবে ভবিষ্যতে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে বলে তিনি মনে করছেন।
রাঙামাটি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ললিত সি চাকমা বলেন, হ্রদ ব্যবস্থাপনায় যারা জড়িত আছেন তাদের আরও সচেতন হতে হবে। যেসব বিভাগ ও সংস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই হ্রদের উপকারভোগী তাদেরও নিজ কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে।
“ভুলে গেলে চলবে না এই হ্রদ এখন জেলাবাসীর খাবার, ব্যবহার্য পানির যেমন প্রধান উৎস, তেমনি নৌ যোগাযোগেরও একমাত্র মাধ্যম।”
সেইসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরকেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
এলাকাবাসী জানায়, পার্বত্য জেলা পরিষদ স্বয়ং হ্রদের জায়গা দখল করে শহরের শহীদ মিনার এলাকায় ফাইভস্টার হোটেলের উদ্যোগ নেয়; পরে জেলা প্রশাসনের বাধায় তা ব্যর্থ হয়।
শুধু রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদই নয়, হ্রদে দুষণ বা দখলে রাঙামাটি পৌরসভাও কম যায় না। পৌরসভার মালিকানাধীন পৌর মার্কেট নির্মিত হয়েছে হ্রদের প্রবাহের উপরই! একই সাথে বর্তমানে নির্মাণাধীন পৌরভবনটিও নির্মিত হচ্ছে হ্রদের উপর।
তবে হ্রদ রক্ষায় রাঙামাটি জেলা প্রশাসনকে মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে দেখা যায়।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশীদ বলেন, “আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাই করি এই হ্রদকে রক্ষা করতে। কিন্তু এই ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষকে। আমরা তো এককভাবে অনেক কিছুই করতে পারি না, সম্ভবও নয়।”
১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণ শুরু করে যা ১৯৬২ সালে শেষ হয়। এর ফলে পরবর্তীতে এখানে বিশাল জলরাশির কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হয়।