সাতক্ষীরায় শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা: ৫০ আসামির সবার সাজা

সাতক্ষীরার কলারোয়ায় দেড় যুগ আগে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় বিএনপির সাবেক এক সাংসদসহ ৫০ আসামির সবাইকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

সাতক্ষীরা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2021, 05:11 AM
Updated : 4 Feb 2021, 02:53 PM

এর মধ্যে সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব এবং বিএনপিকর্মী আরিফুর রহমান ও রিপনকে সর্বোচ্চ দশ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।

এছাড়া কলারোয়া উপজেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের বাচ্চুকে নয় বছরের কারাদণ্ড এবং বাকি ৪৬ জনকে চার থেকে ছয় বছরের সাজা দিয়েছে আদালত।

সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম হুমায়ুন কবীর বৃহস্পতিবার সকালে জনাকীর্ণ এজলাসে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। অভিযুক্ত আসামিদের কেউ এই রায়ে খালাস পাননি।

আসামিদের মধ্যে কারাগারে থাকা ৩৪ জন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বাকি ১৬ জনকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার বিচার কাজ চলে। দণ্ডিতরা সবাই বিএনপি নেতাকর্মী।

আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী এবং আসামি হাবিবুল ইসলাম হাবিবের স্ত্রী শাহনাজ পারভিন বকুল রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এটা সাজানো। আমরা হাই কোর্টে যাব। আমরা সেখানে নিশ্চয় ন্যায্য বিচার পাব।”

অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনীর বলেন, “আমরা সন্তুষ্টও না, অসন্তুষ্টও না। রায় পর্যবেক্ষণ করে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।”

২০০২ সালে এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী ‘ধর্ষণের শিকার’ হলে ওই বছর ৩০ অগাস্ট শেখ হাসিনা সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে তাকে দেখে মাগুরায় যাওয়ার পথে তার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে।

সে সময় হত্যাচেষ্টা, বিস্ফোরক দ্রব্য ও অস্ত্র আইনে তিনটি মামলা করা হয়। কিন্তু এক আসামি হাই কোর্টে গিয়ে মামলা বাতিলের আবেদন করলে আদালতে স্থগিতাদেশ দেয়। তাতে মামলার কার্যক্রম ঝুলে থাকে দীর্ঘদিন।

হাই কোর্ট গতবছর অক্টোবরে তিন মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দিলে নভেম্বরে ফের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।

যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ২৭ জানুয়ারি রায়ের জন্য ৪ ফেব্রুয়ারি দিন রাখেন বিচারক। সেদিনই জামিনে থাকা ৩৪ আসামির জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হয়।

এ রায় ঘিরে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই আদালত এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সংবাদকর্মীরাও রায়ের সংবাদ সংগ্রহের জন্য আদলতে উপস্থিত হন।

রায়ের পর আদালতের বাইরে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ মিছিল করেন স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা সেখানে আনন্দ মিছিল করেন। তবে গোলযোগের কোনো ঘটনা সেখানে ঘটেনি।

রায় ঘিরে আদালতে বাইরে জড়ো হয়েছিলেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা

কী ঘটেছিল

ধর্ষণের শিকার হয়ে চিকিৎসাধীন এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীকে দেখতে ২০০২ সালের ৩০ অগাস্ট সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে যান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

সড়ক পথে ঢাকায় ফেরার সময় কলারোয়া উপজেলা বিএনপি অফিসের সামনে তার গাড়ি বহরে হামলা হয়। বোমা বিস্ফোরণ ও গাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়া হয়।

শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাসহ স্থানীয় নেতাকর্মী ও সাংবাদিকরা সেদিন আহত হন।

ওই ঘটনায় কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোসলেম উদ্দিন কলারোয়া থানায় মামলা করতে গেলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

তখন সাতক্ষীরার আদালতে নালিশি অভিযোগ করেন কলারোয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার মোসলেম উদ্দিন। আদালত অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করতে সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশ দেয়।

ওই মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়।

তদন্ত শেষে তখনকার পুলিশ পরিদর্শক শফিকুর রহমান বিএনপির সাবেক সাংসদ হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন।

হত্যাচেষ্টা, বিস্ফোরক দ্রব্য ও অস্ত্র আইনের পৃথক ধারায় দেওয়া তিনটি অভিযোগপত্রের মধ্যে হত্যাচেষ্টা মামলার রায় হল বৃহস্পতিবার। বাকি দুটি মামলা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।

এ মামলার ৩৪ আসামির জামিন বাতিল গত২৭ জানুয়ারি কারাগারে পাঠানো হয়।

যার যেমন সাজা

কারাগারে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিব এবং পলাতক আরিফুর রহমান ও রিপনকে কয়েকটি ধারায় দুই বছর ছয় মাস, ৫ বছর, ১ বছর, ছয় মাস এবং এক বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

এক ধারার সাজা শেষ হওয়ার পর অন্য ধারার সাজা শুরু হবে। তাতে সব মিলিয়ে তাদের ১০ বছর সাজা খাটতে হবে। আসামিদের হাজতবাসকালীন সময় সাজার হিসাব থেকে বাদ যাবে।  

কলারোয়া উপজেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পলাতক আবদুল কাদের বাচ্চুকে চারটি ধারায় মোট নয় বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মো. আব্দুর রাজ্জাককে দেওয়া হয়েছে ৬ বছরের কারাদণ্ড।  

শেখ তামিম আজাদ মেরিন, মো. আব্দুর রকিব মোল্যা, মো. আক্তারুল ইসলাম, মো. আব্দুল মজিদ, অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ, মো. হাসান আলী, ইয়াছিন আলী,   মো. আব্দুস সাত্তার, রিংকু, মো. আব্দুস সামাদ এবং পলাতক মফিজুল ইসলাম, আব্দুর রবকে সাড়ে চার বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

কারাগারে থাকা আশরাফ হোসেন, নজরুল ইসলাম, তোফাজ্জেল হোসেন সেন্টু, মো. জহুরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মো. আব্দুস সাত্তার, মো. আলতাফ হোসেন, শাহাবুদ্দিন, মো. সাহেব আলী, সিরাজুল ইসলাম, টাইগার খোকন ওরফে বেড়ে খোকন, রকিব, শেখ কামরুল ইসলাম, মো. মনিরুল ইসলাম, ইয়াছিন আলী, শেলী, শাহিনুর রহমান, বিদার মোড়ল, সোহাগ হোসেন, মাহাফুজুর মোল্লা, আব্দুল গফফার গাজী এবং পলাতক খালেদ মঞ্জুর রোমেল, মাজাহারুল ইসলাম, আব্দুল মালেক, রবিউল ইসলাম, গোলাম রসুল, মো. আলাউদ্দিন, সঞ্জু, নাজমুল হোসেন, জাবিদ রায়হান লাকী, কনক ও মো. মাহাফুজুর রহমান বাবুকে চার বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে রায়ে।