পাহাড়ে নারীর বাড়তি গতি এল স্কুটির চাকায়

সংসারের প্রাত্যহিক কাজের মধ্যেও আধুনিক গতিময় জীবনে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে নারীদেরও ছুটতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ কাজ সহজে করতে বান্দরবানের অনেক কর্মজীবী নারীকে স্কুটি চালাতে দেখা যাচ্ছে।

উসিথোয়াই মারমা বান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2021, 04:38 AM
Updated : 17 Jan 2021, 04:39 AM

ঘর সংসার ছাড়াও কোনো কোনো নারীকে সরকারি কিংবা বেসরকারি অফিসে কাজ করতে হয়। তাদের পাল্লা দিতে হয় সময়ের সঙ্গে। তাই স্কুটি ব্যবহার তাদের জীবনে বাড়তি গতির সঞ্চার করে একটু হলেও স্বস্তি এনেছে।

বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে চাকরি করেন হেলেন মারমা।

স্কুটি কেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সকাল হলে সবকিছু সামলাতে হয়। মেয়েকে সময়মত স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, সকালের নাস্তা তৈরি ও রান্না। প্রতিদিন এভাবে ঘর সামলাতেই অনেক সময় দেরি হয়ে যায়। দ্রুত অফিসে যাব এমন সময় একটা রিকশার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। কখনও কখনও ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারি না অফিসে। তাই বাধ্য হয়ে একটা স্কুটি বাইক কিনতে হল।”

শহরে ও পাহাড়ি রাস্তায় স্কুটি চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন কর্মজীবী নারী

তবে স্কুটি কেনার পর শুধু যাতায়াতের সুবিধা বেড়েছে তা নয়, সংসারের অনেক ছোটোখাট কাজ করাও সহজ হয়েছে বলে তিনি জানান। 

হেলেন মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাজার করা থেকে শুরু করে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়াসহ অনেক কাজ সহজ হয়েছে। আগে যা করতে সময় কুলিয়ে উঠতে পারিনি এখন খুব কম সময়ে স্কুটি চালিয়ে করার সুযোগ বেড়েছে। যেকোনো প্রয়োজনে কোথাও গেলে ঠিকভাবে পৌঁছতে পারি।”

যক্ষা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ে আট বছর ধরে কাজ করছেন নিনিপ্রু মারমা। তিনিও সংসারের নানা কাজ শেষ করে অফিসে যেতে ভোগান্তির শিকার হতেন। স্কুটি কিনে তিনি কাজ অনেক সহজ করে এনেছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিনিপ্রু মারমা বলেন, “এত বছর আসা-যাওয়া করেছি রিকশা দিয়ে। সকালে অনেক সময় রিকশা পেতে সমস্যা হয়; দেরি হয়ে যায়, ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছতে পারি না। এই কারণে যাতায়াতের সুবিধার জন্য একটা স্কুটি কিনেছি।”

শহরে ও পাহাড়ি রাস্তায় স্কুটি চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন কর্মজীবী নারী

বান্দরবান জেলা শহর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে রোয়াংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কার্যালয়ে গিয়ে চাকরি করেন সরকারি কর্মজীবী নারী মাম্যায়ি মারমা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করি; অনেক সময় চার চাকা যানে সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয় না। আবার বাস ধরার জন্য অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়। কম সময়ে স্কুটি চালিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারি।”

অফিসে আসা-যাওয়ায় প্রতিদিন ৪২ কিলোমিটার স্কুটি চালাতে হয়; আগে ক্লান্তি লাগলেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে তিন বছর আগেই স্কুটি চালানো শিখেছেন এশানি মারমা ও ডচিংচিং মারমা।

তখন শখের বশে স্কুটি কেনা হলেও এখন কর্মজীবনে বেশ কাজে লাগছে বলে জানান জেলা শহরে উজানিপাড়ার বাসিন্দা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার দুই নারীকর্মী এশানি মারমা ও ডচিংচিং মারমা।

তারা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাহাড়ি এলাকায় মেয়েদের জন্য স্কুটি খুবই উপযুক্ত। এখন কর্মজীবনে প্রবেশ করে স্কুটি চালানোর অভিজ্ঞতা বেশ কাজে লাগছে।

শহরে ও পাহাড়ি রাস্তায় স্কুটি চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন কর্মজীবী নারী

রোয়াংছড়ি উপজেলায় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন মিতালি তঞ্চঙ্গ্যা।

তিনি বলেন, অফিসের বিভিন্ন কাজে ঘুরতে হয় পাহাড়ে দুর্গম এলাকায়। মাঝে-মধ্যে ২১ কিলোমিটার দূরে জেলা শহরে এসেও কাজ সারতে হয়। দূরত্ব ভেদে অটোরিকশা কিংবা বাসে চেপে আসতে হয়।

“কাজগুলো দুর্গম এলাকায় হওয়ায় স্কুটি কিনেছি। বিভিন্ন পাড়ায় সবসময় যেতে হয়। বর্তমানে যখন-তখন যেকোনো জায়গায় যেতে পারি।”

স্কুটি চালানো কর্মজীবী নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শহর এলাকায় আগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা কিছুসংখ্যক নারী কর্মীকে স্কুটি চালাতে দেখা যেত।

এখন সংখ্যা অন্তত দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ‘সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের’ বান্দরবান জেলা সভাপতি ও নারী নেত্রী ডনাইপ্রু নেলী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাহাড়ে নারীদের স্কুটি ব্যবহার নিয়ে সমাজে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও সংখ্যা এখনও বেশি নয়। পাহাড়ের রাস্তা সমতলের মতো নয়। একটু ঝুঁকি নিতে হয়। সমাজের একজন হিসেবে নারীদের তো পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই।

“সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীরাই স্কুটি বাইক ব্যবহার করছেন। তবে সামর্থ্যবান নারীদের অনেকেই শখের বশেও স্কুটি চালাচ্ছেন এখন।”

শহরে ও পাহাড়ি রাস্তায় স্কুটি চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন কর্মজীবী নারী

শহরের মধ্যম পাড়া ও উজানী পাড়ার বাসিন্দা কয়েকজন নারী স্কুটি চালক জানান, তারা মূলত শখের বশে স্কুটি চালান। নিজেদের সার্কেলে একজনের দেখাদেখি অন্যরাও স্কুটি কিনেছেন।

পাইমেচিং মারমা ও সাইংখিমে মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শহরে চাকরিজীবী অনেক নারীকে স্কুটি চালাতে দেখে তাদেরও চালানোর আগ্রহ হয়। বাবা-মার কাছে বললে কিনে দেন।

“তবে শহরে বিভিন্ন পরিবহনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অতি সাবধানে চালাতে হয়। পাহাড়ি এলাকায় বেশি দূরের জায়গায় না গিয়ে শহরের আশপাশ এলাকায় ড্রাইভ করে থাকি।”

সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবী কয়েকজন নারী শহরের সাঙ্গু নদীর সেতুতে

এদিকে শহর এলাকায় স্কুটির সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও আলাদা করে কত সংখ্যক নিবন্ধন করা হয়েছে তা জানানোর সুযোগ নেই বলে জানান বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) জেলা মোটরযান পরিদর্শক মো. সাহাদাত হোসেন চৌধুরী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অফিসে যখন রেজিস্ট্রেশন করা হয় তখন সিসি (সেন্টিমিটার কিউব) হিসেবে ‘হ’ ও ‘ল’ এই দুইটি ক্যাটাগরি করা হয়। আলাদা করে স্কুটি হিসেবে নিবন্ধন করা হয় না।

স্কুটি চালক নারীদের সহযোগিতা করা হচ্ছে জানিয়ে বান্দরবান ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক রাজু দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শুরুর দিকে একটু সমস্যা ছিল। এখন কাগজপত্র ঠিক রেখে স্কুটি চালাচ্ছেন নারীরা।

“কোনো জায়গায় যাতে সমস্যায় পড়তে না হয় সেজন্য ট্রাফিক আইন সম্পর্কেও অবহিত করা হচ্ছে তাদের।”