পুলিশ মেয়েটির বয়স বেশি দেখাতে চেয়েছিল, অভিযোগ মায়ের

ঢাকার কলাবাগানে বন্ধুর বাসায় যৌনাঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণে মারা যাওয়া স্কুলছাত্রীর বয়স পুলিশ বেশি দেখাতে চেয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন তার মা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদককুষ্টিয়া প্রতিনিধি ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Jan 2021, 09:57 AM
Updated : 10 Jan 2021, 03:59 PM

শনিবার কুষ্টিয়ায় পারিবারিক কবরস্থানে মেয়েটিকে দাফনের পর মেয়েটির মা সাংবাদিকদের কাছে এই অভিযোগ করেন।

মেয়েটিকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে তার বিচারের দাবিতে সেখানে মানববন্ধনও করেন স্থানীয়রা।

ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ও লেভেলে পড়ুয়া ওই মেয়েটির পরিবার ইতোমধ্যে ধর্ষণ-হত্যার অভিযোগ তুলে কলাবাগান থানায় মামলা করেছে।

যে বন্ধুর বাড়িতে মেয়েটি ছিল, সেই ইফতেখার ফারদিন দিহানকে (১৮) পুলিশ সে মামলায় গ্রেপ্তারও করেছে।

মেয়েটির মা জানান, গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় তার মেয়ে কোচিং থেকে অ্যাসাইনমেন্ট পেপার আনার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। দুপুর দেড়টার দিকে দিহান তাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে তার মেয়ে অসুস্থ অবস্থায় আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে রয়েছে।

তিনি বলেন, “আমি সেখানে গিয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানতে পারি, মেয়েকে মৃতাবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে।”

মেয়েটির মা বলেন, হাসপাতালে নেওয়ার পর দিহান তার মেয়ের বয়স ‘১৯ বছর’ উল্লেখ করেছিল। পুলিশ সেটাই ধরছিল।

পুলিশ বিকাল ৪টার দিকে সুরতহাল প্রতিবেদন করাসহ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। বিকাল ৫টায় ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগ লাশ গ্রহণ করে।

মেয়েটির মা বলেন, “এসময় সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা বয়স নিয়ে আমরা আপত্তি তুললে পুলিশ ক্ষুব্ধ হয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মর্গে লাশ ফেলে রাখে।”

তিনি তার মেয়ের বয়সের প্রমাণপত্র দেখালেও পুলিশ তা আমল নিচ্ছিল না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

“পরদিন শুক্রবার বয়স প্রমাণের জন্য লাশ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা করা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় পুলিশ। আমি আমার পরিচিতি বিভিন্ন শুভাকাঙ্ক্ষীর সাহায্যে হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানাই। এরপর বিকাল সাড়ে ৫টায় ময়নাতদন্ত শেষ করে আমাদের কাছে লাশ হস্তান্তর করে।”

তিনি জানান, তার মেয়ের জন্মের পর ইস্যুকৃত টিকা কার্ড, স্কুল কার্ড এবং সর্বশেষ পাসপোর্টে তার মেয়ের জন্ম তারিখ ২০০৩ সালের ৯ অক্টোবর লেখা আছে। সে হিসেবে মৃত্যুর সময় বয়স হয় ১৭ বছর ৩ মাস।

তিনি প্রশ্ন তোলেন, “পুলিশ সুরতহাল রিপোর্টে ১৯ বছর বয়স কোথায় পেলেন?”

মেয়েটির চাচা শহিদুল ইসলাম বলেন, স্কুল সার্টিফিকেট এবং পাসপোর্টে সুনির্দিষ্ট বয়স উল্লেখ থাকলেও পুলিশ মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্টে মেয়েটির বয়স দুই বছর বেশি দেখানোসহ নানা গড়িমসি করে ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর ময়নাতদন্ত করেছে।

বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৬ বছরের নিচে কোনো মেয়ের সম্মতি নিয়ে যৌন সম্পর্ক গড়লেও তা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হয়। আবার দেশে ১৮ বছরের নিচের বয়সীরা শিশু হিসেবে আইনিভাবে স্বীকৃত।

সেদিন গ্রেপ্তারের পর দিহান পুলিশের কাছে দাবি করেছিল, তারা ‘পারস্পরিক সম্মতিতে’ শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল।

পুলিশ বলেছে, তারা ধর্ষণসহ সব অভিযোগ খতিয়ে দেখে তদন্ত করছে।

এদিকে মেয়েটিকে হাসপাতালে নেওয়ার পর দিহানের সঙ্গে তার তিন বন্ধু ছিল, যাদের পুলিশ আটক করলেও পরে ছেড়ে দেয়।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মেয়েটির বাবা।

তিনি কুষ্টিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, “প্রথমে আমি দিহানসহ আরও তিনজনের নামোল্লেখসহ এজাহার দিলে পুলিশ তাদের আটক করে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর কলাবাগান থানা পুলিশ আমার দেওয়া এজাহার পরিবর্তন করে শুধু দিহানকে আসামি করে মামলা রেকর্ড করে।

“সে সময় পুলিশ আমাকে বলে, যেহেতু দিহানের বাসা থেকে ঘটনাটি ঘটেছে, সেই কারণে শুধু দিহানকে আসামি করে মামলা করলে সঠিক বিচার হবে।”

“কিন্তু চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে যতটুকু জানতে পেরেছি, মেয়ের উপর যে নৃশংস ঘটনা ঘটেছে, তাতে এই ঘটনার সাথে কোনোভাবেই একজন জড়িত নয় বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস,” বলেন তিনি।

ইফতেখার ফারদিন দিহান

দিহানকে ‘সঠিকভাবে’ জিজ্ঞাসাবাদ করলেই জড়িত অন্যদের তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে বলে মনে করেন তিনি।

মেয়েটির ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “তার শরীরের কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া না গেলেও যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথে ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে। বিকৃত যৌনাচারের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে।”

পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার সাজ্জাদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ওই মেয়েটি ও দিহানের বন্ধুত্ব বেশ কয়েক বছরের, যা তাদের পরিবারের সদস্যরাও জানত।

মেয়েটির পরিবার অভিযোগ তোলার পর উপ কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বয়স বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগটি ঠিক নয়।

“হাসপাতালের রেজিস্টারে এবং বিভিন্ন পরীক্ষার সময় হাসপাতালে যে বয়স দেখানো হয়, সেখানে ১৯ বছর বয়স লেখা হয়েছে। হাসপাতালে পেপার্সে স্কুলছাত্রীর স্বজনের স্বাক্ষরও আছে।

“এটা পুলিশের প্রাথমিক সূত্র। এখান থেকে পুলিশ বয়সের তথ্য নিয়েছে। এছাড়া তার বয়স নির্ধারণের জন্য তার নমুনাও নেওয়া হয়েছে। এটার রিপোর্ট পাওয়া গেলে বয়স কত তা জানা যাবে।”

মামলায় আসামির তালিকায় একাধিক ব্যক্তির নাম সংযুক্ত করতে না দেওয়ার অভিযোগও প্রত্যাখ্যান করেন উপকমিশনার সাজ্জাদুর।

তিনে বলেন, “তারা যে আবেদন দিয়েছে, পুলিশ সেটাই নিয়ে মামলা হিসাবে নথিভুক্ত করেছে। এখানে পুলিশের করণীয় কিছু নেই। পুলিশ কাউকে যুক্ত করতে পারে না, কাউকে বাদও দিতে পারে না।”