এই শ্রমিকরা শিল-নোড়া খোদাই করে জীবিকা নির্বাহ করেন। অন্যান্য দিন-মজুরির চেয়ে কম খাটুনিতে প্রায় সমপরিমাণ উপার্জন হওয়ায় ঝুঁকি জেনেও তারা বাপ-দাদার আমলের এই পেশায় রয়েছেন।
পাথরে খোদাই করার সময় নাক, মুখ ও লোমকূপ দিয়ে পাথরের কণা, ধুলা শরীরে প্রবেশ করে। এই কারণে শ্বাসযন্ত্র সংশ্লিষ্ট নানা রোগে তারা আক্রান্ত হন।
জয়পুরহাট মডার্ন জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এভাবে পাথরের ধুলা শ্বাস-প্রশাসের সঙ্গে ফুসফুসে গিয়ে ফুসফুসের নানা জটিলাতার সৃষ্টি করে। এতে দিন দিন ফুসফুস দুর্বল হয়ে পড়ে। অল্প বয়সে মানুষ মৃত্যু-ঝুঁকিতেও পড়ে।
চক্রপাড়া গ্রামের ৬০/৬৫ জন এই শিল-নোড়ার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
চক্রপাড়া গ্রামে সরেজমিনে দেখা গেছে, বাড়ির বাইরে একটু দূরে ঝোপে-ঝাড়ে ছোটো ও মাঝারি আকারের গুদাম ঘর রয়েছে। প্রতিটি গুদাম ঘরের টিনের ছাউনী দেওয়া বারান্দায় বসে কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ নানা বয়সী শ্রমিক ছেনি আর হাতুড়ি নিয়ে ঠুং ঠাং শব্দে পাথর কেটে তৈরি করে চলেছেন মরিচ ও মশলা বাটার শিল-নোড়া।
শিল-নোড়া শ্রমিক মামুনুর রশিদ (৪২), রেজোয়ান মোল্লা (৪৫), আনিছুর রহমানসহ (৪২) কয়েকজন বলেছেন তাদের জীবন-জীবিকার কথা।
তারা জানান, এই গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দাই দরিদ্র। অনেক আগে এখানে বেশ কিছু শিল-নোড়া খোদাই শিল্পী ছিলেন, তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাড়ির শিল-নোড়ায় ধার কেটে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কয়েক জন মহাজন ৩০/৩৫ বছর আগে ভারত থেকে পাথর এনে কেটে শিল-নোড়া তৈরিসহ খোদাইয়ের কাজ শুরু করেন। তারপর থেকে ধীরে ধীরে এই ব্যবসা এই গ্রামে প্রসার লাভ করে।
তারা আরও জানান, প্রতি সেট শিল-নোড়া (একটি পাটা ও একটি শীল) কাটলে শ্রমিকরা ৪০ থেকে ৪৫ টাকা মজুরি পান। দিনে একজন শ্রমিক সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৪ সেট শিল-নোড়ার কাজ করতে পারেন।
শ্রমিক মামুনুর রশিদ জানান, সাধারণ মজুরি খেটে বা শ্রমিকের কাজ করে দিনে সর্বোচ্চ রোজগার হয় ৩৫০ টাকা থেকে ৫শ টাকা। শিল-নোড়া তৈরি করেও একই পারিশ্রমিক পাওয়া যায়। তবে ঠান্ডা হাওয়া বা ছায়ায় বসে শিল-নোড়া তৈরির কাজ করে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যায় বলে এই গ্রামের গরিব মানুষরা এই পেশার প্রতি বেশ আকৃষ্ট।
রেজোয়ান মোল্লা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজে শ্রমিকদের ধরে রাখতে মহাজনরা পারিশ্রমিকের অগ্রিম টাকাও দিয়ে থাকেন। সেদিক থেকে বলতে গেলে এটা এই কাজের কিছুটা বাড়তি সুবিধাও বটে।
শ্রমিকরা জানান, ৩০/৩৫ আগে এই পেশার শুরুর দিকে গ্রামে দুই শতাধিক শ্রমিক থাকলেও এখন কাজ করছেন ৫০ থেকে ৬০ জন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক মনে করেন তাদের উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা দিলে সুন্দরভাবে এই পেশায় জীবনও কাটাতে পারেন।
আগে অনেক মহাজন থাকলেও এখন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন শহিদুল ইসলাম, ফারুক হোসেন, ফজলুর রহমান, মাসুদ রানা ও বেলাল হোসেনসহ ৬/৭ জন ব্যবসায়ী।
মহাজনদের ভাষ্য, এই গ্রামের মহাজনরা ব্যবসা বন্ধ করে দিলেও শ্রমিকরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে এই একই কাজ করবেন; কারণ একই পরিমাণ পারিশ্রমিকে অন্য পেশায় পরিশ্রম ও কষ্ট বেশি।
এদিকে, গ্রামের সায়েম উদ্দিন, ফারুখ হোসেন, সানোয়ার, মঞ্জুর, আমিনুরসহ বেশ কয়েকজন স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণে প্রশাসনের কাছে শিল-নোড়া তৈরির কাজ বন্ধের দাবি জানান।
এই ব্যাপারে আক্কেলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাবিবুল হাসান বলেন, আগে চক্রপাড়া গ্রামে ব্যাপকভাবে এই কাজ চলেছে। বর্তমানে কমে যাওয়ার কারণ হল অনেক শিল-নোড়া শ্রমিককে সামজিক বেষ্টনীর আওতায় এনে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। আবার কাউকে কাউকে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্ম দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আবার বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে কাউকে সহায়তা করা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
“এরপরও কিছু সংখ্যক মানুষ এই পেশা ছাড়তে পারছেন না। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের কর্ম সৃষ্টি করে সেখানে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।”
এই বিষয়ে জয়পুরহাট সিভিল সার্জন ওয়াজেদ আলী বলেন, “আমি সবেমাত্র যোগদান করেছি। স্বাস্থ্য ঝুঁকির এই পেশা বন্ধ করতে হলে প্রথমেই তাদের বিকল্প পেশায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা অতি জরুরি। এতে সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে বলেই ধীরে ধীরে এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা কমে যচ্ছে।”