অবশেষে ২৬ দিন পর লাকিংমের লাশ পেল বাবা-মা

প্রায় এক মাস হাসপাতালের হিমঘরে পড়ে থাকার পর কক্সবাজারের কিশোরী লাকিংমে চাকমার মরদেহ পেয়েছেন তার বাবা-মা।  

কক্সবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Jan 2021, 12:37 PM
Updated : 4 Jan 2021, 12:37 PM

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শাহীন মো. আবদুর রহমান চৌধুরী জানান, সোমবার লাকিংমের বাবা-মা ও চাচাত ভাই হাসপাতাল থেকে মরদেহ গ্রহণ করেন।

এই সময় লাকিংমে অপহরণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়ানের এসআই অর্জুন চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শীলখালী গ্রামের চাকমা পাড়ার লালা অং চাকমার মেয়ে লাকিংমে চাকমা (১৫)।

গত বছরের ৫ জানুয়ারি লাকিংমেকে অপহরণ করা হয় বলে তার পরিবারের অভিযোগ। তার প্রায় এক বছর পর গত ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লাকিংমে চাকমাকে কয়েকজন যুবক কক্সবাজার সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন; চিকিৎসকের ভাষ্য এর আগে লাকিংমের মৃত্যু হয়েছে।

এসআই অর্জুন চৌধুরী হাসপাতাল চত্বরে সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তে লাকিংমে চাকমার বয়স নাবালিকা অর্থাৎ প্রচলিত আইনে বিয়ের উপযুক্ত হয়নি বলে সত্যতা পাওয়া গেছে। তাই তার যদি বিয়ে হয়েও থাকে তা আইনগতভাবে অবৈধ। তাই সার্বিক বিবেচনায় তার ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য তার মরদেহ বাবা-মার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। 

এটি একটি অপহরণ মামলা হিসেবে আদালতে বিচার কাজ চলবে, বলেন মামলার এই তদন্ত কর্মকর্তা।

এসআই অর্জুন জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হিমঘরের ভাড়া বাবদ ২৪ হাজার টাকা দাবি করার পর মরদেহ হস্তান্তরে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। লাকিংমের দরিদ্র পরিবার ওই টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। পরে র‌্যাব-১৫ কক্সবাজারের উপ-অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান বিষয়টি অবগত হয়ে র‌্যাবের পক্ষ থেকে হিমঘরের ভাড়া পরিশোধ করার ব্যবস্থা করেন। এরপর মরদেহ হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। 

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আরএমও শাহীন মো. আবদুর রহমান চৌধুরী বলেন, গত ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লাকিংমে চাকমাকে কয়েকজন যুবক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। ওই সময় তারা চিকিৎসকদের জানান যে মেয়েটি বিষপান করেছে।

“তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।”

আরএমও জানান, বিষয়টি হাসপাতালে কর্মরত পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ লাকিংমের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। ১০ ডিসেম্বর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়।

আরএমও শাহীন আরও জানান, এরমধ্যে আতাউল্লাহ নামে এক যুবক নিজের স্ত্রী দাবি করে লাকিংমের মরদেহ তাকে হস্তান্তরের জন্য পুলিশের কাছে আবেদন করেন। অন্যদিকে মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর পেয়ে লাকিংমের বাবা লালা অংও হাসপাতালে এসে সন্তানের মরদেহ পাওয়ার আবেদন করেন।

এরপর আইনি জটিলতা শুরু হওয়ায় লাকিংমের মরদেহ কাউকে দেওয়া হয়নি।

এসআই অর্জুন জানান, গত ১৫ ডিসেম্বর লালা অং চাকমা মরদেহ পেতে টেকনাফ বিচারিক হাকিম আদালতে আবেদন করেন। আদালত শুনানি করে আবেদনটি গ্রহণ করে লাকিংমের ধর্ম পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে র‌্যাবকে দায়িত্ব দেয়।

আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মংথেলা রাখাইন বলেন, গত ২৮ ডিসেম্বর মানবাধিকার কর্মীদের একটি দল টেকনাফে লাকিংমে চাকমার বাড়ি যায়। এই দলের সদস্যরা লাকিংমের পরিবার, গ্রামবাসী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আতাউল্লাহর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। পরদিন দলটির সদস্যরা লাকিংমের বাবার উপস্থিতিতে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেন। 

লাকিংমের বাবা লালা অং চাকমা বলেন, গত বছরের ৫ জানুয়ারি তার মেয়েকে একই ইউনিয়নের মাথাভাঙ্গার আতাউল্লাহসহ চার-পাঁচ জন যুবক অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান।

তিনি বলেন, ঘটনার দিনই বিষয়টি স্থানীয় ইউপি সদস্য মোহাম্মদ হাফেজকে জানিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন জায়গায় তার মেয়েকে খুঁজতে থাকেন। আতাউল্লাহর স্বজনদের সঙ্গেও দেনদরবার করেন।

তিনি বলেন, এরপর টেকনাফ থানায় অপহরণের মামলা দায়েরের চেষ্টা করলে ওই সময়ে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ মামলা না নিলে তিনি আদালতে যান।  

২৭শে জানুয়ারি তিনি নিজে বাদী হয়ে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে আদেশ দেন।

লালা অং চাকমা বলেন, ওই মামলায় তিনি অভিযোগ করেন তার মেয়ে বয়সে শিশু। ইউনিয়ন পরিষদের দেওয়া জন্মসনদ অনুযায়ী তার মেয়ের বয়স ১৪ বছর ১০ মাস। জন্ম সনদে লাকিংমের জন্ম ২০০৫ সালের ২রা মার্চ।

মেয়ে স্বেচ্ছায় যায়নি, তাকে আতাউল্লাহরা অপহরণ করেছে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।

গত ৯ অগাস্ট পিবিআই পরিদর্শক ক্যশেনু মারমা তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন।

প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা ক্যশেনু উল্লেখ করেন, “আমি এই মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি এবং সাক্ষীদের সাথে কথা বলেছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দিও নেওয়া হয়েছে। পাঁচজন সাক্ষীই ভিকটিম লাকিংমের আত্বীয়। ওই পাঁচজন ছাড়া কেউ লাকিংমেকে অপহরণ করা হয়েছে এমন বলেননি।”

তাই লাকিংমে স্ব-ইচ্ছায় চলে গেছে মর্মে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

কিন্তু পিবিআই কর্মকর্তার এই তদন্ত প্রতিবেদন লাকিংমের স্বজনরা মানেননি।

মামলার বাদীর আইনজীবী মোহাম্মদ মহিউদ্দীন খান জানান, বাদী লালা অং তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনের উপর নারাজি দিয়েছেন। এই বিষয়ে আদালত পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছেন ২৮শে জানুয়ারি।   

লাকিংমে যেদিন মারা যান তার ১৩ দিন আগে এক ছেলের জন্ম হয়েছে। নবজাতক এখন আতাউল্লাহর মায়ের কাছে রয়েছে।  

গত ২৮শে ডিসেম্বর লাকিংমে চাকমার গ্রাম পরিদর্শনে যাওয়া মানবাধিকার কর্মী দলের সদস্য কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারাহ তানজিম টিটিল বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও আতাউল্লাহর পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে এবং লাকিংমের বয়স সংত্রুান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র যাছাই-বাছাই করে দুইটি বিষয় পুরোপুরি স্পষ্ট হয়েছে।  

“তা হলো লাকিংমে স্ব-ইচ্ছায় কারো সাথে যায়নি, সে পরিকল্পিত অপহরণের শিকার। দ্বিতীয়ত দেশের প্রচলিত আইনমতে সে নাবালক এবং তার বিয়ের বয়স হয়নি।”

কক্সবাজারে প্রতিবাদ কর্মসূচি

সকাল ১১টায় কক্সবাজার জেলা শহরের পৌরসভা কার্যালয়ের সামনের সড়কে লাকিংমে চাকমার অপহরণ, বাল্য বিয়ে, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরিত করার প্রতিবাদ এবং এরজন্য দায়ীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, হিউম্যান রাইটস্ ডিফেন্ডারস ফোরাম, নারী প্রগতি সংঘ, রাখাইন ওমেন ফোরাম, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, তঞ্চংগ্যা স্টুডেন্টস কাউন্সিল এই কর্মসূচির আয়োজন করে।