দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও অব্যাহতির সুপারিশ

ঠাকুরগাঁওয়ে সরকারি প্রকল্পের চাল আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ মিললেও আসামিকে অব্যাহতির সুপারিশের অভিযোগ পাওয়া গেছে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Dec 2020, 06:54 PM
Updated : 28 Dec 2020, 08:55 AM

দুর্নীতির এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদক দিনাজপুরের সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক সাইদুর রহমান গত ৮ ডিসেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, সাধারণ সহায়তা (জিআর) প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১২, ২১ ও ২৬ জুন সদর উপজেলার মসজিদের ওয়াজ মাহফিল, মন্দিরের নামযজ্ঞ ও মাদ্রাসার এতিমখানায় খাবারের জন্য ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ২১৭ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়, যার মূল্য প্রায় ৮২ লাখ টাকা। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ থেকে এসব চাল ছাড় করা হয়। ১৮৯টি প্রকল্পের মাধ্যমে সে বছরের ৩০ জুনের মধ্যে সব চাল তুলে নেওয়া হয়।

এর মধ্যে সদর উপজেলার ঢোলারহাট ইউনিয়নের ৩৪টি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩৪ টন চাল।

এই প্রকল্পগুলো থেকে চাল আত্মসাতের অভিযোগ উঠলে ২০১৯ সালের মার্চে এই ঘটনার অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদক দিনাজপুরের সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক সাইদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর সদর উপজেলার ঢোলারহাট ইউপি চেয়ারম্যান সীমান্ত কুমার বর্মণ, সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া, সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বিপ্লব কুমার সিংহ রায়, খাদ্যগুদামের তিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাঈদুল ইসলাম, সাহাব উদ্দীন ও এসএম গোলাম মোস্তফাকে দুদক দিনাজপুর সমন্বিত কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। পরে দুদক তাদের আটক করে।

সাইদুর জানান, এরপর দুদক দিনাজপুর সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আহসানুল কবীর পলাশ এই আটকদের বিরুদ্ধে ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে জাল কাগজপত্র তৈরি করে’ ৬ টন সরকারি প্রকল্পের চাল আত্মসাতের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন।

ঠাকুরগাঁওয়ের বিশেষ আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মো. হাছানুজ্জামান পরদিন [ওই বছরের ১৪ নভেম্বর] তাদের কারাগারে পাঠান।

সাইদুর রহমান জানান, তিনি নিজে দুদকের পক্ষ থেকে চাল আত্মসাতের এই ঘটনা তদন্ত করেন এবং ওই প্রতিবেদন কমিশনে পাঠিয়ে দেন। পরে চলতি বছরের [২০২০ খ্রি.] ২৯ নভেম্বর দুদকের কমিশনার (তদন্ত) এএফএম আমিনুল ইসলাম এক চিঠির মাধ্যমে আদালতে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) দাখিলের অনুমোদন দেন।

ওই চিঠির বরাত দিয়ে সাইদুর রহমান আরও বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক দাখিলকৃত সাক্ষ্য ও অন্যান্য রেকর্ড পর্যালোচনা করে উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন পরিতুষ্ট হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের অনুমোদন দেয়।

অনুমোদন পেয়ে সাইদুর রহমান গত ৮ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন বলে জানান।

সাইদুর রহমানের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে জাল স্বাক্ষরের মাধ্যমে ৬ মেট্রিক টন চাল আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। ঢোলারহাট ইউপি চেয়ারম্যান সীমান্ত কুমার বর্মণ ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই ৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দের চাল বিক্রি করে সরকারি কোষাগারে দুই লাখ ৩৪ হাজার ৬০৮ টাকা ১০ পয়সা জমা দিয়েছেন।

চুড়ান্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পাঁচ আসামি বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও একজন ইউপি চেয়ারম্যান বিধায় এত স্বল্প টাকা আত্মসাৎ ও মামলা রুজুর পর দীর্ঘদিন হাজতবাসের কারণে এক রকম শাস্তিভোগ করেছেন। এই অবস্থায় আসামিদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে মামলাটির এফআরটি [চূড়ান্ত প্রতিবেদন] দাখিলের সুপারিশসহ কর্তৃপক্ষের বরাবরে সাক্ষ্য-স্মারক দাখিল করা হয়। অতপর দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয় অনুমোদন জ্ঞাপন করায় মামলার এফআরটি বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করা হলো।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদক দিনাজপুরের সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক সাইদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মামলার আসামিরা সম্মানিত ব্যক্তি। তারা দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছেন; আর আত্মসাতের টাকার পরিমাণও কম। আত্মসাতের টাকা তারা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে দিয়েছেন। এই কারণে তাদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

“কর্তৃপক্ষ এটা অনুমোদন দিয়েছেন। সেই প্রেক্ষিতে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আদালত এ প্রস্তাব গ্রহণ নাও করতে পারেন।”

চাল আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার পরও মামলার দায় থেকে আসামিদের অব্যাহতির সুপারিশের খবর পেয়ে ঢোলারহাট এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

গত বুধবার [২৩ ডিসেম্বর] এলাকাবাসী মামলাটি পুনরায় তদন্তের দাবি জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত আবেদন পাঠিয়েছেন।

এই বিষয়ে ঢোলারহাট ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারি চাল আত্মসাতের ঘটনার প্রমাণ পাওয়ার পরও মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তে এলাকায় দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে মনি করি।”

ঠাকুরগাঁও আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারি প্রকল্পের চাল আত্মসাতের মামলার তদন্ত করে দুদকের উপসহকারী পরিচালক  আদালতে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন তা আদালত মানবেন বলে মনে হয় না। কারণ অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার পরও আসামির মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশের সুযোগ নেই।”

এই মামলার বিবাদীর আইনজীবী মোস্তাক আলম বলেন, দুদকের পক্ষ থেকে গত ৮ ডিসেম্বর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। আগামী বছরের ১১ জানুয়ারি এনিয়ে শুনানি হবে। এই তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করা বা প্রত্যাখান করা আদালতের এখতিয়ার।

এই বিষয়ে দুদক দিনাজপুরের সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবু হেনা মো. আশিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই মামলায় আত্মসাতের টাকার পরিমাণ অল্প ছিল। পরে তারা সেটা পরিশোধ করে দিয়েছেন। আসামিরা বরখাস্ত হয়েছিলেন।

“এসব বিষয় বিবেচনা করে মাননীয় কমিশন তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখানে তদন্তকারী কর্মকর্তার হাতে আসলে কিছু নেই।”