দক্ষিণ-পশ্চিমে আশার পিদিম জ্বালছে পদ্মা সেতু

পদ্মাসেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোয় নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এরই মধ্যে নতুন শিল্পকারখানার খবরও মিলছে।

শুভ্র শচীন খুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Dec 2020, 07:51 AM
Updated : 20 Dec 2020, 08:28 AM

খুলনাকে এক সময় শিল্পনগরী বলা হলেও যোগাযোগ, অবকাঠামো ও গ্যাস না থাকাসহ নানা কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে একে একে বন্ধ হয়ে যায় সব শিল্প প্রতিষ্ঠান। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে খুলনা অঞ্চল। কাজের খোঁজে এলাকা ছাড়ে অনেক মানুষ। তবে পদ্মসেতু হলে এ পরিস্থিতির বদল হবে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

খুলনা বিভাগীয় বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তপক্ষের (বিডা) পরিচালক প্রণব কুমার রায় বলেন, এ অঞ্চলে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন। এর ফলে এ অঞ্চলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হচ্ছে।

তিনি বলেন, গত চার বছরে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ১১৪টি ছোট, বড়ো ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিনিয়োগ হয়েছে ১৩ হাজার ২২৭ কোটি ৩৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে ২১ হাজার ৫৪৯ জনের।

নতুন গড়ে ওঠা উল্লেখযোগ্য শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যে রয়েছে, জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল, এলপি গ্যাস, অটো রাইস মিল, মাছের হ্যাচারি ও হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, ফুড অ্যান্ড এলাইড প্রোডাক্টস, ক্যাটল, প্রোল্ট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড, প্রকৌশল শিল্প, রসায়ন শিল্প, ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্টিলাইজার, কোল্ড স্টোরেজ, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, উড অ্যান্ড পার্টিকেল বোর্ড প্রসেসিং, ডক ইয়ার্ড শিল্প, সার্ভিস (সেবা শিল্প), ডেইরি প্রোডাক্টকস অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম, অটোমেটিক ব্রিক ফিল্ড, প্লাস্টিক প্রোডাক্টকস, নির্মাণ শিল্প, পোল্ট্রি হ্যাচারি, পাওয়ার প্লান্ট এবং চামড়া ও ট্যানারি শিল্প।

খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলার গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি-আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন।

তিনি আশা করছেন, খুলনার হিমায়িত মৎস্য ও পাট শিল্প থেকে আয় আরও বাড়বে। কমে যাবে পণ্য পরিবহন খরচ। সেতুতে রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকায় দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহন, সাধারণ মানুষের যাতায়াতসহ পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গেও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। দ্রুত শিল্প কারখানা তৈরি হবে এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

ব্যবসায়ী নেতা কাজী আমিন জানান, মোংলা বন্দরসহ আশপাশের এলাকায় দেশের বড় বড় শিল্পগ্রুপের জমি কেনা রয়েছে। তারা অপেক্ষায় রয়েছেন। খানজাহান আলী বিমানবন্দর এবং চাহিদা মতো গ্যাস সরবরাহ হলে এ অঞ্চল হবে ‘দেশের সবচেয়ে’ শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল।

তিনি দেশের ভেতর ছাড়াও ভুটান, পূর্ব নেপাল ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশের জন্য পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করছেন।

পদ্মাসেতু ছাড়াও এ অঞ্চলে আরও কয়েকটি মেগা প্রকল্প রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, বাগেরহাটের ফয়লায় বিমান বন্দর, খুলনা-মোংলা রেললাইন, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোরে দু’টি ইপিজেড, খুলনায় শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, পাইপলাইনে গ্যাস, দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা, শিল্পশহর নওয়াপাড়া নদীবন্দর, বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল, ভোমরা ও দর্শনা স্থলবন্দরের উন্নয়ন, বেনাপোল থেকে সরাসরি ঢাকা ট্রেন যোগাযোগ বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খুলনার সদ্য বিদায়ী বিভাগীয় কমিশনার ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. নাসিফ আহসান বলেন, রাজধানীর সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে ঢাকা-মোংলা বন্দরের অন্তত ৮৭ কিলোমিটার দূরত্ব কমে আসবে। ব্যবসায়ীরা সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মোংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হবেন। আবার খুলনায় ফিরতে শুরু করবে মানুষ। 

“বর্তমান অবস্থায় মোংলা বন্দর থেকে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন বাণিজ্য সম্ভব। পদ্মা সেতু চালু হলে তা বেড়ে ১০ বিলিয়নে চলে যাবে।”

মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর, সুন্দরবনসহ এ অঞ্চলে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প গড়ে উঠবে। সার্বিকভাবে দক্ষিণাঞ্চল একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোনে পরিণত হবে। যা দেশের জিডিপিতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ অবদান রাখতে পারবে বলে মনে করছেন তিনি।

নদীর মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরুর জন্য দীর্ঘ আন্দোলন করেছে খুলনা অঞ্চলের মানুষ। এসব আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি।

এ কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, একটি সেতুতে কত মানুষের আবেগ-ভালোবাসা জড়িত এটা বোঝানো সম্ভব নয়।

“সেতুর শেষ স্প্যান স্থাপনের দৃশ্য দেখে আনন্দে চোখের পানি ফেলেছি। আমার মতো অনেকের চোখেই আনন্দ অশ্রু ঝরেছে।”

পদ্মা সেতুতে চলাচল শুরু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। তখন সকালে খুলনা থেকে বের হয়ে ঢাকায় গিয়ে কাজ সেরে বিকেলেই খুলনায় ফেরা যাবে বলেন তিনি।

তিনি বলেন, মোংলার সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের উত্তর-পূর্বাংশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বন্দরও গতি পায়নি। পদ্মা সেতুর কারণে সেই সংকট দূর হয়েছে। পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকাসহ অন্য অঞ্চলে দ্রুত পণ্য পাঠানো সহজ হওয়ায় মোংলা বন্দর দ্রুত গতিশীল হবে। মোংলা বন্দর কাছে থাকায় অন্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরাও এখানে নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত হবেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মামুন অর রশিদ বলেন, এ সেতুকে ঘিরে এরই মধ্যেই নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, সারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে পদ্মাসেতু।

পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে প্রায় ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার (১৭,০০০ বর্গ মাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯ শতাংশ অঞ্চলজুড়ে তিন কোটিরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। এ অঞ্চলের কৃষি, যোগাযোগ, শিল্পায়ন, নগরায়ন, জীবনমানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধি, দারিদ্র বিমোচন এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে প্রত্যাশা করছেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারি অনুসারে এক হিসেবে দেখা যায়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে ছিল খুলনা ও বরিশাল। সেই দিন আর থাকবে না বলে আশা এ অঞ্চলের মানুষের।